জন্ডিসের কারণ ও করণীয়

জন্ডিসের কারণ ও করণীয় এটি কোনো রোগ নয়, যকৃতে প্রদাহ কিংবা পিত্তাশয়, পিত্তনালী বা অগ্ন্যাশয়ের বিভিন্ন সমস্যার উপসর্গ হল জন্ডিস।রক্তে বিলিরুবিনের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া বা এর উৎপাদন কিংবা সঞ্চালন প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ার কারণে জন্ডিস দেখা দেয়। জন্ডিসের খুঁটিনাটি সম্পর্কে জানালেন ফাস্ট কেয়ার হসপিটালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ কামরুল হাসান।

জন্ডিসের কারণ ও করণীয়

লক্ষণঃ প্রধান লক্ষণ হল চোখ ও প্রসাবের রং হলুদ হয়ে যাওয়া। সমস্যা বেশি হলে পুরো শরীর গাঢ় হলুদবর্ণ ধারণ করতে পারে। অনেকসময় পায়খান সাদা হয়ে যাওয়া, চুলকানি, যকৃত শক্ত হয়ে যাওয়া ইত্যাদি উপসর্গও দেখা যায়। এছাড়া শারীরিক দুর্বলতা, ক্ষুধামন্দা, জ্বর, বমি, পেটব্যথা ইত্যাদি তো আছেই।

কারণঃ ডা. মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, “জন্ডিসের কারণকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। ‘হেপাটোসেলুলার’, ‘অবস্ট্রাকশন’ এবং ‘হেমোলাইটিক এনিমিয়া’। জন্ডিসে আক্রান্ত হলে অবশ্যই ডাক্তার দেখানোর মাধ্যমে এর কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে।

হেপাটোসেলুলারঃ ডা. কামরুল ইসলাম জানান, আমাদের দেশের মানুষের জন্ডিস হওয়ার শতকরা ৭০ ভাগ কারণ হচ্ছে ভাইরাল হেপাটাইটিস। হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি এবং ই ভাইরাসের সংক্রমণে যকৃতে প্রদাহ সৃষ্টি হওয়াকে বলা হয় ভাইরাল হেপাটাইটিস। এদের মধ্যে হেপাটাইটিস বি ও হেপাটাইটিস সি’র সংক্রমণে যকৃতে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সারের মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এক্ষেত্রে জন্ডিস ভালো হলে যাওয়ার পরও নিয়মিত যকৃত পরীক্ষা করানো উচিত। এই চিকিৎসক বলেন, “হেপাটাইটিস এ এবং হেপাটাইটিস ই ভাইরাস ছড়ায় দুষিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে। আর হেপাটাইটিস বি, সি এবং ডি ছড়ায় এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত বা রক্ত উপাদান গ্রহণের মাধ্যমে।” তিনি আরও জানান, এমনকি আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত সুঁচ ব্যবহার করলেও এই ভাইরাস ছড়ানো সম্ভব।

এদের মধ্যে হেপাটাইটিস এ এবং হেপাটাইটিস বি’র প্রতিষেধক টিকা পাওয়া যায়। তবে টিকা দিলেও ভাইরাল হেপাটাইটিসের ঝুঁকি পুরোপুরি কমে না। স্থায়ীভাবে হেপাটাইটিস এ এবং হেপাটাইটিস বি’র ঝুঁকি এড়াতে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

জন্ডিসের কারণ

অবস্ট্রাকশনঃ শরীরের লোহিত রক্ত কণিকাগুলো ভেঙে বিলিরুবিন তৈরি হয়। এই বিলিরুবিন যকৃতে প্রক্রিয়াজাত হয়ে পিত্তরসের সঙ্গে মিশে পিত্তনালীর মাধ্যমে পরিপাকতন্ত্রে প্রবেশ করে। সবশেষে পায়খানার সঙ্গে তা শরীর থেকে বের হয়ে যায়।

পিত্তনালী, পিত্তথলি, অগ্ন্যাশয়, গল ব্লাডারে পাথর বা টিউমারের কারণে বিলিরুবিনের এই সঞ্চালন প্রক্রিয়া ব্যাহত হলে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যায়, ফলে জন্ডিস হয়— জানালেন ডা. হাসান। এ ধরনের রোগীর দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়ার পরামর্শ দিলেন তিনি।

হেমোলাইটিক এনিমিয়াঃ রক্তকণিকা স্বাভাবিকের তুলনায় দ্রুত ভেঙে গেলে বা রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যাওয়ার কারণে জন্ডিস হওয়াকে হেমোলাইটিক এনিমিয়া বলা হয়। এ ধরনের জন্ডিসের ক্ষেত্রে চোখের সাদা অংশ হলুদ হওয়ার পাশাপাশি চোখের পাতার ভেতরের অংশ সাদা হয়ে যেতে পারে।

প্রতিরোধ ও প্রতিষেধকঃ “পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা, জীবাণুমুক্ত খাবার ও পানীয় গ্রহণ করাই জন্ডিসের আক্রমণ থেকে বাঁচার মূলমন্ত্র। রাস্তাঘাটে পানি, ফলের জুস, সরবত ইত্যাদি খাওয়ার ক্ষেত্রে সাবধান হতে হবে। সময়মত হেপাটাইটিস এ এবং বি’র টিকা নিতে হবে।” পরামর্শ দিলেন এই চিকিৎসক।

তিনি আরও জানান, হেপাটাইটিস বি’র ক্ষেত্রে প্রথম মাসে একটি, দ্বিতীয় মাসে একটি বা ছয়মাসের মধ্যে একটি ডোজ দেওয়া হয়। হেপাটাইটিস এ’র ক্ষেত্রে একটি ডোজই যথেষ্ট। আর দুই ক্ষেত্রেই পাঁচ বছর পরপর বুস্টার টিকা দেওয়া হয়। প্রতিটি টিকার দাম বেসরকারীভাবে সাধারণত ৭শ’ থেকে ৮শ’ টাকা হয়ে থাকে। তবে জন্ডিস হলে টিকা নিয়ে কোনো লাভ হয় না। তাই সুস্থ থাকতে আগেই টিকা নিতে হবে।

জন্ডিসের চিকিৎসা সম্পর্কে ডা. হাসান বলেন, “যেহেতু জন্ডিস কোনো রোগ নয়, তাই এর কোনো ওষুধ নেই। সাত থেকে ২৮ দিনের মধ্যে রক্তে বিলিরুবিনের পরিমাণ স্বাভাবিক হয়ে গেলে জন্ডিস এমনিতেই সেরে যায়।” তিনি আরও বলেন, “জন্ডিস হলে রোগীকে পুরোপুরি বিশ্রাম নিতে হবে। যকৃতের প্রতি অতিরিক্ত যত্নবান হওয়া প্রয়োজন। প্রচুর শর্করাজাতীয় ও ভিটামিন-সিযুক্ত খাবার খেতে হবে। গ্লুকোজ, আখের রস, আনারস ইত্যাদি জন্ডিস রোগীর জন্য উপকারী।”

জন্ডিসের কারণ করণীয়

“জন্ডিস হলে প্যারাসিটামল, অ্যাসপিরিন বা ঘুমের ওষুধ খাওয়া উচিত নয়। পরিপাকতন্ত্রে জমে থাকা জীবাণুগুলো যাতে প্রদাহ তৈরি করতে না পারে সেজন্য রোগীকে প্রতিদিন কমপক্ষে একবার হলেও পায়খানা করা নিশ্চিত করতে হবে।” বললেন তিনি। ডা. কামরুল হাসান পরামর্শ দিতে গিয়ে আরও জানান, জন্ডিস কোনো রোগ নয় বলে একে মোটেও অবহেলা করা উচিত নয়।

জন্ডিসের চিকিৎসা নিয়ে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। কেউ ঝাড়ফুঁক করে জন্ডিস নামায়, রোগীকে অতিরিক্ত হলুদ দিয়ে রান্না করা খাবার খাওয়ান, কেউ আবার বিভিন্ন গাছের শেকড় খান। এগুলো সম্পুর্ণ ভুল ধারণা। জন্ডিস হলে সরাসরি ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

Check Also

Where Do Health Care Assistants Work? A Comprehensive Guide

Where Do Health Care Assistants Work? A Comprehensive Guide

Health care assistants play a crucial role in the medical field, offering hands-on care to …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *