যুদ্ধাপরাধ এর সংজ্ঞা – কিভাবে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয় যুদ্ধাপরাধ হচ্ছে কোন যুদ্ধ বা সামরিক সংঘাত চলাকালে কোন ব্যক্তি কর্তৃক বেসরকারী জনগণের বিরুদ্ধে সংগঠিত, সমর্থিত ও নির্দিষ্ট সংজ্ঞায়িত অপরাধ কর্মকাণ্ডসমূহ। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুসারে যুদ্ধকালীন সংঘাতের সময় বেসরকারী জনগনকে খুন, লুন্ঠন, ধর্ষণ; কারাগারে অন্তরীন ব্যক্তিকে হত্যা নগর, বন্দর, হাসপাতাল কোন ধরনের সামরিক উস্কানি ছাড়াই ধ্বংস প্রভৃতি যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়।
১৮৯৯ ও ১৯০৭ সালের হেগ কনভেনশন সর্বপ্রথম যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত আইনসমূহ লিপিবদ্ধ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সংগঠিত হওয়া নূরেমবার্গের হত্যাকাণ্ড ও অপরাধ বিচার সবচেয়ে আলোচিত যুদ্ধাপরাধ বিচার। আধুনিক যুদ্ধাপরাধের সংজ্ঞা প্রদানের ক্ষেত্রে ১৯৪৫ সালের লন্ডন ঘোষণাকে আদর্শ হিসেবে ধরা হয়।
বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের সাথে জড়িত সংগঠন কারা
শান্তি কমিটিঃ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান প্রশাসনকে সহযোগিতা করার লক্ষ্যে ১০ এপ্রিল তারিখে ঢাকায় শান্তি কমিটি গঠিত হয়। শান্তি কমিটি গঠনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীকে সহায়তা করা এবং দেশকে বিচ্ছিন্নতা থেকে রক্ষা করে পাকিস্তানি হুকুমত বজায় রাখা। ক্রমান্বয়ে সারাদেশে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। স্বাধীনতা বিরোধী রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীরা এসব কমিটি গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করে।
রাজাকার বাহিনীঃ ১৯৭১ সালের মে মাসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সামরিক সরকার তাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে ‘রাজাকার’ নামে একটি আধা-সামরিক বাহিনী গড়ে তোলে। এই বাহিনীর মোট সদস্য সংখ্যা ছিল পঞ্চাশ হাজার। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রধান সহযোগী হিসেবে এই বাহিনী দায়িত্ব পালন করে। বিশেষ করে গ্রাম অঞ্চলে এই বাহিনীর অত্যাচারের চিহ্ন আজো বিদ্যমান।
আল-বদর বাহিনীঃ ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে ময়মনসিংহে এই বাহিনী গঠিত হয়। সম্পূর্ণ ধর্মীয় আদর্শের উপর ভিত্তি করে এই বাহিনীর গঠন ও কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী বিশেষ ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে এই বাহিনীকে ব্যবহার করা হয়। আল-বদর বাহিনীর কার্যকলাপের মধ্যে বুদ্ধিজীবী হ-ত্যাকাণ্ড অন্যতম। মিরপুর বধ্যভূমি এই বাহিনীর হ-ত্যাযজ্ঞের সাক্ষ্য বহন করে।
শীর্ষ পাঁচ যুদ্ধাপরাধঃ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী স্বাধীনতা-বিরোধী এক শ্রেণীর ধর্মান্ধ ও শিক্ষিত তরুণ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ও ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দলের উদ্যোগে আল-শামস বাহিনী গঠন করে। আল বদর বাহিনীর সঙ্গে মিশে এরা দেশের স্বাধীনতাকামী ব্যক্তিদের এবং স্বাধীনতা লাভের পূর্বক্ষণে বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হ-ত্যা করে।
বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের প্রকৃতিঃ বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের প্রকৃতি খুবই ভয়াবহ ও লোমহর্ষক। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি সশস্ত্র হায়েনা বাহিনী তাদের এদেশীয় কুচক্রী মহল নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে হ-ত্যা, লুট, ধর্ষণ, অগ্নিকাণ্ড ও বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক তাণ্ডবলীলা চালায়।
যুদ্ধাপরাধ এর সংজ্ঞা – কিভাবে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়
এরা নির্বিচারে গণহ-ত্যা, গণধর্ষণ, লুন্ঠন ও অগ্নিসংযোগে অংশ নেয়। ভয়াল দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লাখ মুক্তিকামী বাঙালি শাহাদতবরণ করে, সম্ভ্রম হারায় ২ লাখ মা-বোন। উপরিউক্ত দিকগুলো ছাড়াও বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের উল্লেখযোগ্য কিছু প্রকৃতি তুলে ধরা হলো:
আইনভঙ্গঃ আইনভঙ্গ, সনদ ও চুক্তিপত্র অমান্য মুক্তিযুদ্ধকালে বর্বর পাকিস্তানিরা আইনভঙ্গ, সনদ ও চুক্তিপত্র অমান্যের সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করে। এ সময় ইয়াহিয়া খান ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা বিমান ও নৌবাহিনী ব্যবহারের সংশ্লিষ্ট সকল আইন ভঙ্গ, জাতিসংঘের সনদ পদদলিত, ১৯৪৮ সালের গণহ-ত্যা চুক্তিসভাপত্র অমান্য,
১৯৪৯ সালের চারটি চুক্তিসভাপত্রও অগ্রাহ্য, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক নয় এমন এক সশস্ত্র সংঘর্ষকালে যে সকল নিয়ম মানতে প্রতিটি রাষ্ট্র বাধ্য তা অমান্য, নিরাপরাধ লোকের অধিকার হরণ, সংঘর্ষকালে ত্রাণকার্য সম্পর্কিত আইনকানুন অগ্রাহা এবং সংস্কৃতি সংরক্ষণ সম্পর্কিত আইনও তারা ভঙ্গ করেছে।
হ-ত্যা ও সম্পত্তি বিনষ্টঃ পাকিস্তানিরা জাতিগত, জাতীয়তাগত, ভাষাগত, ধর্মগত, সংস্কৃতিগত, গোত্রগত, ভেদনীতি গ্রহণ করে অসামরিক নর-নারীকে হ-ত্যা, অসামরিক জনসাধারণের সম্পত্তি বিনষ্ট এবং একটি জাতির সকল অস্তিত্ব ধ্বংসের হীন প্রচেষ্টা চালিয়েছে। আর তাদের এ প্রচেষ্টায় সহায়তা করেছে এদেশীয় ঘৃণ্য দোসররা।
বিদেশী পত্রিকার প্রতিবেদনঃ বিদেশী পত্রিকার প্রতিবেদন ও প্রতিবেদকের মন্তব্যে ধ্বংসযজ্ঞ ১৯৭১ সালে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ প্রকৃতি শুধুমাত্র দেশীয় পত্রিকার মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল না বরং দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের নাম করা পত্রিকাগুলোর সচিত্র প্রতিবেদন ও প্রতিবেদকের মন্তব্যে চিত্র ফুটে উঠেছে। নিচে এমন কয়েকটি পত্রিকার প্রতিবেদন ও প্রতিবেদকের মন্তব্য উল্লেখ করা হলো-
টাইমস্ অফ ইন্ডিয়াঃ আমেরিকান এইড (AID) কার্যসূচির অধীনে ৩ বছর ঢাকায় ছিলেন জন রোড নামক জনৈক আমেরিকান কর্মকর্তা। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে বৈদেশিক সম্পর্ক কমিটির সামনে যে জবানবন্দী দেন (টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ২ মে ১৯৭১) তাতে তিনি বলেন যে, পূর্ব বাংলায় জঙ্গলের আইন চালু রয়েছে।
সুপরিকল্পিত উপায়ে নিরস্ত্র বেসামরিক জনসাধারণ, বুদ্ধিজীবী হিন্দুদের হ-ত্যা করা হচ্ছে। তিনি ২৯ মার্চ ১৯৭১ রমনা কালীবাড়ি পরিদর্শন করে দেখেন যে, সেখানে ২০০ থেকে ৩০০ লোক হ-ত্যা করা হয়েছে। মেশিনগানের গুলি খেয়ে, আগুনে পুড়ে নর-নারী ও শিশুদের মৃতদেহ পড়ে আছে। সকল জায়গা ধূলিসাৎ করে দেয়া হয়।
কিভাবে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়
নিউইয়র্ক টাইমস্ঃ নিউইয়র্ক টাইমস্ ৩০ মার্চ ১৯৭১ সালে প্রদত্ত রিপোর্টে উল্লেখ করে, সর্বত্র বেসামরিক ব্যক্তিদের সেনাবাহিনী হ-ত্যা করেছে।
টাইমঃ ৩ মে ১৯৭১ নিউইয়র্কের সাপ্তাহিক টাইম পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়, একজন যুবক সৈন্যদের কাছে আকুল প্রার্থনা জানায় তাকে যা কিছু করা হোক না কেন, তার ১৭ বছরের বোনটিকে যেন রেহাই দেয়া হয়। তার সামনেই বেয়নেট দিয়ে বোনটিকে হ-ত্যা করে পশুরা।
ল্য এক্সপ্রেস পত্রিকার প্রতিবেদকের মন্তব্যঃ ফ্রান্সের ‘ল্য এক্সপ্রেস’ পত্রিকার সাংবাদিক তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা দেন এভাবে, ‘প্রতি রাতেই আমি মেশিনগান ও মর্টারের গুলির শব্দ শুনতাম। বাঙালিদের তাড়িয়ে তাড়িয়ে ধরতো সৈন্যরা, তারপর যানবাহনের পেছনে এমনভাবে বেঁধে দিত যাতে তাদের মাথা মাটিতে বারবার এসে আঘাত হানে।’
সানডে টাইমসঃ সানডে টাইমস পত্রিকায় পাকিস্তানস্থ প্রতিনিধি (১৩ জুন ১৯৭১ সংখ্যা) জানিয়েছেন যে, ‘পুরান ঢাকায় কয়েকটি এলাকা নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার সময় সান্ধ্য আইনের সময় যে শত শত মুসলমানদের পাকড়াও করা হয়েছিল তাদেরও কোনো চিহ্ন পরবর্তীতে আর মেলেনি।
১৫ এপ্রিল ১৯৭১ তিনি ঢাকায় ঘোরার সময় দেখেছেন যে, ‘ইকবাল হলের (বর্তমান জহুরুল হক হল) দুটি সিঁড়িতে প্রচুর রক্ত তখনও ছড়িয়ে আছে এবং হলের ছাদে চারজন ছাত্রের মাথা তখনও পচছে। দেয়ালে গুলির দাগ এবং রীতিমত ডিডিটি পাউডার ছড়িয়ে দেয়া সত্ত্বেও চারদিকে দুর্গন্ধ। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে ২৩ জন মহিলা ও শিশুর পচা লাশ সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।’
সানডে টেলিগ্রাফঃ লন্ডনের সানডে টেলিগ্রাফ পত্রিকা ৪ এপ্রিল ১৯৭১ পাকিস্তানি কুচক্রীদের মানসিকতা ও ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা ও মন্তব্যে লেখে, ‘গত সপ্তাহে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নৃশংসভাবে গণপ্রজাতান্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকামী পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের জীবনীশক্তি নিঃশেষ করা ছাড়া আর সবই করেছে।
পাকিস্তানের জেনারেল ও কর্নের্লরা খুব সাবধানে দু’বছর ধরে যে পরিকল্পনা করেছে তারই ফল এই নৃশংসতা। তাদের অনেকেই ব্রিটিশদের হাতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত, অনেকেই চারিত্রিক নম্রতায় না হলেও বাহ্যিক ব্যবহারে ‘ব্রিটিশদের চাইতেও ব্রিটিশ’।’
শীর্ষ পাঁচ যুদ্ধাপরাধঃ ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা বাংলাদেশে ১৭ ধরনের যুদ্ধাপরাধ, ১৩ ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং ৪ ধরনের গণহ-ত্যাজনিত অপরাধসহ মোট ৫৩ ধরনের অপরাধে লিপ্ত ছিল। এ প্রসঙ্গে শীর্ষ পাঁচ যুদ্ধাপরাধ হলো-
(i) ১৯৭১ সালের ২৫ ও ২৬ মার্চ ঢাকায় ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে সেনা অভিযানে নির্বিচারে ৫০ হাজার বাঙালি নিধন। যুদ্ধকালীন সর্বমোট ৩০ লাখ বাঙালিকে নৃশংসভাবে হ-ত্যা।
(ii) লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও দেশজুড়ে হ-ত্যাকাণ্ড।
(iii) মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পূর্বপরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী এবং বিভিন্ন পেশাজীবী যেমন চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আমলা, ছাত্র ও সমাজকর্মীদের হ-ত্যা এবং তাদের গণকবর দেয়া।
(iv) হাজার হাজার বাঙালি নারীকে ধর্ষণ ও নিগ্রহ।
(v) এদেশ থেকে হিন্দু জাতিসত্তাকে নির্মূলের জন্য হ-ত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতন।
দেশে দেশে যুদ্ধাপরাধ ও বিচার
যুদ্ধাপরাধ একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ। এটি এখন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের আওতায় চলে এসেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শান্তি ও মানবতার বিরুদ্ধে যে কোনো অপরাধকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে নানা আঙ্গিকে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে। আবার যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত হয়েছে বিভিন্ন ট্রাইব্যুনাল ও কোর্ট। নিচে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
যুদ্ধাপরাধ ও আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের ধারণাঃ ১৮৯৯ সালে ফিলিপাইন-আমেরিকান যুদ্ধকালীন সময়ে শান্তিপূর্ণ সমাধানের উদ্দেশ্যে হল্যান্ডে আয়োজিত Hague Peace Conference-1-এ প্রথমবারের মতো Laws of war এবং War crime-গুলোকে চিহ্নিত করে তা আন্তর্জাতিক আইন হিসেবে গ্রহণ করার জন্য প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয়। এখানে প্রথমবারের মতো যুদ্ধাপরাধ ও আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের কনসেপ্টের সূচনা হয়েছিল।
বিচারের ঘোষণা ও আইন পাসঃ ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান থেকে দেশে আসার পর রেসকোর্স ময়দানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ঘোষণা দেন। Bangladesh Collaborators (Special Tribunals) Order, 1972 নামে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য প্রথম আইন পাস হয়।
দালাল আইন প্রয়োগঃ ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির ঘোষণা দ্বারা প্রবর্তিত দালাল আইনটির প্রয়োগ শুরু হয় ফেব্রুয়ারি মাস থেকে তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু করার মাধ্যমে।
সংশোধনী ও বিচার আরম্ভঃ ১৯৭২ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত আইনটির তিন দফা সংশোধনী হয়। এ আইনের অধীনে ৩৭ হাজারেরও বেশি ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিভিন্ন আদালতে তাদের বিচার আরম্ভ হয়।
সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা
১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৮ ধরনের অপরাধে জড়িতদের বাইরে রেখে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। এই মহামান্য রাষ্ট্রপতি ১৮ ধরনের অপরাধ ক্ষমা করতে পারেন তা হলো-
১. বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর চেষ্টা;
২. বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর ষড়যন্ত্র;
৩. রাষ্ট্রদ্রোহিতা;
৪. হ-ত্যা;
৫. হ-ত্যার চেষ্টা;
৬. অপহরণ;
৭. হ-ত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ;
৮. আটক রাখার উদ্দেশ্যে অপহরণ;
৯. অপহৃত ব্যক্তিকে গুম ও আটক রাখা;
১০. ধর্ষণ;
১১. দস্যুবৃত্তি;
১২. দস্যুবৃত্তিকালে আঘাত;
১৩. ডাকাতি;
১৪. খুনসহ ডাকাতি;
১৫. হ-ত্যা বা মারাত্মক আঘাতসহ দস্যুবৃত্তি অথবা ডাকাতি;
১৬. আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে ক্ষতিসাধন;
১৭. বাড়িঘর ধ্বংসের উদ্দেশ্যে আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহার;
১৮. ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৪৩৬ ধারা (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে কোনো জলযানের ক্ষতিসাধন) অথবা এসব কাজে উৎসাহ দান।
সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার প্রভাব
বঙ্গবন্ধু কর্তৃক সাধারণ ক্ষমা ঘোষণাকালীন কারাগারে ৩৭ হাজার ৪১ জন বন্দি ছিল। ৭৩টি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল করে তাদের বিচার কাজ চালানো হচ্ছিল। এ সাধারণ ক্ষমার আওতায় ২৫ হাজার ৭১৯ জন অভিযুক্ত ব্যক্তি ছাড়া পেয়ে যায়। সুনির্দিষ্ট অভিযোগে আটক বাকি প্রায় ১১ হাজারের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার চলছিল।
১৯৭৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ২ হাজার ৮৮৪টি মামলার নিষ্পত্তি হয়। এতে মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল ১৯ জনের, বাকিদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। মূলত দালাল আইনেই এ বিচারকার্য পরিচালনা করা হয়।
যুদ্ধাপরাধ এর সংজ্ঞা ভিডিও দেখুন…
যুদ্ধবন্দিদের বিচারের দাবি
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ৯৩,০০০ আত্মসমর্পণকারী যুদ্ধবন্দিকে ভারতীয় হেফাজতে নিয়ে যাওয়া হয়। আত্মসমর্পণের পরপরই বাংলাদেশ এ পর্যায়ে ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিকে যুদ্ধাপরাধ ও গণহ-ত্যার অভিযোগে বিচারের জন্য শনাক্ত করে। তবে ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সম্পাদিত সিমলা চুক্তি অনুযায়ী যুদ্ধবন্দিদের নিরাপদে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানোর সম্ভাবনা দেখা দেয়, এ প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দির বিচারের জোর দাবি জানাতে থাকে। প্রস্তাবিত বিচারের বিরুদ্ধে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক আদালতে একটি আনুষ্ঠানিক আবেদনও পেশ করে।
চুক্তি স্বাক্ষরঃ যুদ্ধবন্দিদের বিচারের দাবির প্রেক্ষিতে ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা ১৯৭৩ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে ইসলামাবাদ ও দিল্লিতে আরেকটি চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য পুনরায় বৈঠকে মিলিত হয়। দুই দেশের মধ্যে সম্পাদিত শেষ চুক্তি অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট গুরুতর যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ১৯৫ জন ব্যতীত বাকি সকল যুদ্ধবন্দিকে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা চূড়ান্ত হয়।
যুদ্ধবন্দিদের বিচারের দাবি প্রত্যাহারঃ ১৯৭৪ সালে লাহোরে ইসলামী ঐক্য সংস্থার শীর্ষ সম্মেলন এবং পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের পর তিনটি দেশ অর্থাৎ পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা নয়াদিল্লিতে পুনরায় বৈঠকে মিলিত হয় এবং দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে বাংলাদেশকে ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দির বিচারের দাবি প্রত্যাহারে রাজি করানো হয়।
নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারঃ ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সংক্রান্ত বিষয়টি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করে এবং জনগণকে এ মর্মে নির্বাচনে প্রতিশ্রুতি দেয় যে, তারা সরকার গঠন করতে পারলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলার এ মাটিতে নিশ্চিত করবে। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়ী হয়।
এরপর সরকার গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করে, যা শেষ করার অভিপ্রায়ে। এখনো কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রজ্ঞাপন জারি ও সংশোধনী পাসঃ মার্চ ২০১০ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল, তদন্ত সংস্থা ও আইনজীবী প্যানেল গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। ২০০৯ সালের ৯ জুলাই জাতীয় সংসদে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) অ্যাক্টের সংশোধনী পাস করা হয়।