কোটাপদ্ধতির যৌক্তিক সংস্কারের পর বর্তমানে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা দীর্ঘদিন ধরে সাধারণদের জন্য ৩০ বছর নির্ধারিত। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই বয়সসীমা বৃদ্ধির দাবি ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং শিক্ষাব্যবস্থার বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করলে, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি একটি সময়োপযোগী দাবি। তাই এই বিষয়ে গভীর বিশ্লেষণ ও নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা প্রয়োজন। সরকারি চাকরির বয়সসীমা বাড়ানোর জন্য প্রথমেই নীতিমালা পরিবর্তনের প্রয়োজন।
বয়সসীমা একটি স্থির বিষয় হিসেবে না দেখে, নিয়মিত পর্যালোচনা করা উচিত। সময়ের সাথে সাথে মানুষের গড় আয়ু ও কর্মক্ষমতার মেয়াদ বেড়েছে, তাই বয়সসীমাও সেই অনুযায়ী বাড়ানো যেতে পারে। চাকরির বয়সসীমা বাড়ানোর জন্য জনমত গঠন ও আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়োজন কিছু সমন্বিত কার্যকর উদ্যোগ। চাকরির বয়সসীমা ৩৫ বছর করার পক্ষে এবং বিপক্ষে যুক্তিগুলো সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রার্থীদের সুযোগ-সুবিধা এবং কর্মক্ষেত্রে কর্মক্ষমতা ও উদ্ভাবনের বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। তবে তা যেন সমাজের বিভিন্ন স্তরের দাবির প্রতিফলন হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেশনজট একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। বর্তমানে শিক্ষার পরিধি ও সময়সীমা বাড়ায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য শিক্ষার্থীদের অনেক সময় লাগে, বিশেষ করে যাঁরা উচ্চতর ডিগ্রি (মাস্টার্স, পিএইচডি) অর্জন করতে চান। ফলে ৩০ বছর বয়সের মধ্যে তাঁরা চাকরির জন্য প্রস্তুতি নেওয়া এবং আবেদন করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। তাই বয়সসীমা বৃদ্ধি হলে এই শিক্ষার্থীরা যেন চাকরির প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারেন সেই বিবেচনায় বয়সসীমা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে তরুণ জনগোষ্ঠীর একটি বিশাল অংশ এখনো চাকরি পাচ্ছে না। একদিকে কর্মসংস্থানের অভাব, অন্যদিকে সামাজিক ও পারিবারিক চাপের কারণে অনেকেই পড়াশোনা শেষ করার পরপরই চাকরি খুঁজতে বাধ্য হন। তবে সব সময়ই তা সম্ভব হয় না। এ ছাড়া অনেকেই ব্যক্তিগত বা পারিবারিক কারণে পড়াশোনা সম্পন্ন করতে দেরি করে ফেলেন। এসব কারণে তাঁদের জন্য চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।অধিকাংশ উন্নত দেশে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর বা তারও বেশি।
ফলে সেসব দেশের শিক্ষার্থীরা তাঁদের শিক্ষাজীবন শেষে চাকরির প্রস্তুতির জন্য পর্যাপ্ত সময় পান। বাংলাদেশেও একই ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তরুণেরা তাঁদের কর্মজীবনের শুরুতে যথেষ্ট সময় ও সুযোগ পাবেন, যা তাঁদের কর্মদক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। বর্তমান সময়ে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, তাই অনেকেই দীর্ঘ সময় কর্মক্ষম থাকতে পারেন। কর্মক্ষেত্রে পরিপক্বতা এবং অভিজ্ঞতা অনেক সময় তত্ত্বীয় জ্ঞানের চেয়ে বেশি কার্যকর। মানসিক ও শারীরিকভাবে তাঁরা আরও স্থিতিশীল হয়ে ওঠেন। এটি কর্মক্ষেত্রে তাঁদের সফলতা অর্জনে সহায়তা করে। তবে বয়সসীমা বেশি বাড়ালে তাঁদের তুলনায় বয়স্ক প্রার্থীরা বেশি সময় পাবেন, যা তরুণ প্রার্থীদের জন্য নিরুৎসাহিত হতে পারেন ও নতুনত্বের অভাব কর্মক্ষেত্রের স্বাভাবিক উন্নয়ন এবং উদ্ভাবনে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। সেই সঙ্গে পেশাগত দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানের ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
সামগ্রিকভাবে চাকরির বয়সসীমা নির্ধারণে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং কর্মক্ষমতার দীর্ঘায়ু বিবেচনা করা উচিত। এ ছাড়া সরকারি এবং বেসরকারি চাকরিতে বয়সসীমার মধ্যে বৈচিত্র্য রাখা যেতে পারে। অভিজ্ঞ পেশাজীবী, বিশেষায়িত ক্ষেত্র যেমন প্রযুক্তি, গবেষণা এবং অন্যান্য বিশেষায়িত ক্ষেত্রগুলোতে বয়সসীমা শিথিল করা উচিত। তবে মানুষের বয়সের সঙ্গে শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতার পরিবর্তন ঘটে। কিছু ক্ষেত্র যেমন পুলিশ, সামরিক বাহিনী বা অন্যান্য শারীরিক পরিশ্রমের কাজগুলোতে বয়সসীমা কঠোর হতে পারে।
লেখক: এম নাহিদুল ইসলাম নাহিদ, অফিসার, রূপালী ব্যাংক পিএলসি