কুয়াশার মতো সম্পূর্ণ গল্প এক সাথে। রোমান্টিক ভালোবাসার গল্প

গল্পঃ- কুয়াশার মতো
পর্বঃ- ০১ (প্রথমাংশ ও দ্বিতীয়াংশ একসঙ্গে)
লেখাঃ- মোঃ সাইফুল ইসলাম সজীব।

– মা বললো ” তোর স্বামীর জন্য রোজরোজ ভাত রান্না করি নাকি? প্রতিদিন রাতে এসে বসে থাকে, লজ্জা সরম কিছু নাই নাকি?

– সে কি ভাত চাইছে মা?

– না চাইলে ও তো আমরা বুঝি, তাছাড়া ড্রইং রুমে বসে থাকলে ডাইনিং রুমে বসে কীভাবে খাবো আমরা?

– আমার সঙ্গে যেভাবে কড়া কথা বলো সেভাবে ওর সঙ্গে বলতে পারো না মা? আমি তো পছন্দ করে বিয়ে করিনি, তোমাদের পছন্দের ছেলে।

– আমার হয়েছে যত জ্বালা, তোর বাবা নিজের রুমে বসে বকবক করে। সে নিজেও কিছু বলতে পারে, কিন্তু তা না করে সবকিছু আমার উপর।

– সত্যি করে বলো তো মা, তুমি আর বাবা আমাকে কি আর ওর সঙ্গে সংসার করতে দেবে না?

– পাগল নাকি তুই? তোর বাবা ডিভোর্সের সকল ব্যবস্থা করতে বলেছে উকিলকে।

– তাহলে কি আমি ওর সামনে গিয়ে আজকে সরাসরি বলে দেবো যে আর কোনদিন আমাদের বাড়ি যেন না আসে। তার ডিভোর্স পেপার সে বাসায় পেয়ে যাবে, বলবো মা?

– পারবি শাকিলা? সেটাই বলে দে, প্রতিদিন আর সহ্য করতে পারি না।

– ঠিক আছে যাচ্ছি আমি।

ড্রইং রুমে বসে বসে সকাল বেলার পুরনো পত্রিকা খুলে পড়ছে সাজ্জাদ, আমার স্বামী। আমি তার সামনে যেতেই সে দাঁড়িয়ে গেল, বাসা থেকে চলে আসার পড় এটাই আমাদের প্রথম দেখা। সে ঠিক প্রতিদিন আসে কিন্তু আমি কোনদিনই সামনে আসি না।

সেই চেহারা নেই, চোখ গুলো কেমন কোটরে ঢুকে গেছে, সম্পুর্ণ পোশাক যেন অন্যরকম। এভাবে এর আগে কখনো দেখিনি ওকে,

– আমি বসতে বসতে বললাম, কেমন আছো?

– ভালো।

– চা-নাস্তা করা হয়েছে?

– শুধু চা দিয়েছিল।

– তো বাসায় যাবে কখন? প্রতিদিন এতো রাত করে বসে থাকো, বিরক্ত লাগে না?

– না, আর তোমার জন্য তো অপেক্ষা করি। তুমি সামনে এলে তো বসে থাকতে হতো না, আমার সঙ্গে তুমি কথা বলো না কেন?

– কথা বলতে ইচ্ছে করে না তাই বলি না।

– তোমার নাম্বার বন্ধ করে রাখছো।

– হ্যাঁ, তাহলে বুঝতেই পারছ তোমার সঙ্গে কথা বলার কোন ইচ্ছে নেই বলে তো বন্ধ।

– আমার ভুল হয়ে গেছে।

– কিসের ভুল সাজ্জাদ? আজব।

– তাহলে আমাকে রেখে কেন এখানে আছো, তুমি কি আমার সঙ্গে থাকবে না শাকিলা?

– না সাজ্জাদ, তুমি তো জানো সরাসরি কথা বলা আমার বেশ পছন্দের। আজও তোমার সামনে আসার কোন ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু তুমি প্রতিদিন রাতে এসে বসে থাকো, বিশ্রী লাগে।

– আমার কি করা উচিৎ?

– তুমি কি জানো হয়তো মা-বাবা সবাই তোমার প্রতি খুব বিরক্ত?

– হ্যাঁ জানি, কিন্তু তুমি তো আমাকে পছন্দ করো ভালোবাসো, তাই আসি।

– যদি বলি আমিও তোমার প্রতি খুব বিরক্ত তবে কি আর আসবে না?

– মনে হয় আসবো না, কিন্তু আমি জানি তোমার কোনদিনই বিরক্ত আসবে না।

– তোমার জানায় ভুল আছে, আমি তোমাকে এখন খুবই বিরক্ত মনে করি। নাহলে অনেক আগেই তোমার সঙ্গে চলে যেতাম, নাহলে একা একা বাসায় যেতাম।

– চুপচাপ।

– একটা কথা বলবো?

– হুম বলো।

– তুমি আর এসো না, বাবার এক বন্ধুর সঙ্গে বাবা আমাদের বিষয় কথা বলেছেন। তিনি মনে হয় শীঘ্রই ডিভোর্সের সকল কাগজপত্র নিয়ে আসবে।

– ওহ্, তোমার ইচ্ছেতে?

– হ্যাঁ।

– আমি কি আমার অপরাধ জানতে পারি?

– তোমার কোন অপরাধ নেই, তুমি অতিরিক্ত ভালো মানুষ। আর সেটাই তোমার সমস্যা, তবে বাবার সমস্যা হচ্ছে তোমার কারণে নাকি বাবার অফিসে একটা সমস্যা হয়েছে।

– হ্যাঁ কিছুটা, আমাদের একটা কাজ তোমার বাবার অফিসের করার কথা ছিল। তাদের কাজের মান ভালো না তাই আমি কাজটা অন্য কোম্পানি কে দিতে বলেছি আমাদের স্যার কে।

– তোমার কি উচিৎ ছিল না বাবার কথা শোনা?

– কাজের সময় কাজ, বাসায় এলে শশুর জামাই সম্পর্ক, তাই আগে কাজ।

– এটাই সমস্যা, যাইহোক আমি তোমার কাজের প্রতি শ্রদ্ধা করি।

– তাহলে আমার সঙ্গে চলো।

– সেটা সম্ভব না, আগেই বলছি। বাবার যেমন সমস্যা তার অফিসে, আমারও তেমন কিছু সমস্যা আছে বাসাতে। তবে বলতে চাই না।

– আচ্ছা ঠিক আছে।

– তুমি এখন চলে যাও, আর কোনদিন আসার দরকার নেই।

– ভাত খেয়ে যাই?

– না, বাসায় গিয়ে খেও, তোমার জন্য এখানে অতিরিক্ত রান্না করা হয় না।

– তোমার জন্য তো হয়? সেখান থেকে নাহয় একটু খেতে দিলে।

– সাজ্জাদ…? অদ্ভুত কথাবার্তা সব।

– আচ্ছা সরি, এমনিতেই ফাজলামো করেছি। তো ভালো থেকো সবসময়।

সাজ্জাদ উঠে দাঁড়িয়ে গেল, দরজা খুলে একাই বের হয়ে গেল। আমি দরজা বন্ধ করার জন্য এগিয়ে গেলাম, পিছন থেকে ডাক দিয়ে বললাম,

– বাসায় রান্না করো নাকি হোটেলে খাও?

– সাজ্জাদ ঘুরে তাকাল, বলল, কোনটাই না। হোটেলের খাবার সহ্য হয় না, আর বাসাতে কেন যেন রান্না করতে ইচ্ছে করে না। সারাদিন শুকনো খাবার খেয়ে চলে যায়, আর রাতে তো তোমাদের বাসায় খেতাম। আজ থেকে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।

সাজ্জাদ সিঁড়ি বেয়ে নিচে চলে গেল, আমি দরজা বন্ধ করে নিজের রুমে চলে গেলাম। ঘন্টা খানিক পড়ে বাবার চিৎকারে রুম থেকে বের হলাম, বাবা বলল,

– ইচ্ছে করেই চাবি ফেলে গেছে, চাবি নেবার বাহানা ধরে আবার আসবে।

– বললাম, কি হয়েছে বাবা?

– সাজ্জাদ বাসার চাবি ফেলে গেছে মনে হয়।

– তাহলে চিৎকার করো কেন? এলে আবার দিয়ে দেবে তাতেই তো হয়ে যায়।

– কোন দরকার নেই, চাবি নিচে গিয়ে দারোয়ান এর কাছে রেখে আসবো। সে এলে দারোয়ান তাকে চাবি দিয়ে দেবে।

আমি চুপচাপ রুমে চলে গেলাম, বাবা চাবি নিয়ে চলে গেছে নিচে। অন্ধকার রুমের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে জীবনের হিসাব মেলাতে লাগলাম।

রাত দুইটা।
দরজা খুলে নিচে গেলাম, দারোয়ান কাকা বসে বসে ঝিমাচ্ছে। আমি তাকে ডাক দিতেই তিনি ধড়ফড়িয়ে উঠলেন।

– কে কে কে?

– কাকা আমি শাকিলা।

– ওহ্ তুমি?

– কাকা আমার হাসবেন্ড এসেছিল?

– না আসেনি এখনো।

– যদি আসে তাহলে তাকে চাবি দেবার সময় বলবেন আগামীকাল সকালে আমি বাসায় যাবো। সে যেন সকাল বেলা আমাকে নিতে আসে, বাসায় যেতে হবে না, রাস্তায় দাঁড়ালে হবে।

– আচ্ছা।

সকাল বেলা মায়ের ডাকে ঘুম থেকে উঠে শুনি বাড়ির দারোয়ান কাকা আমাকে ডাকছে। আমি মনে মনে ভাবলাম যে সাজ্জাদ হয়তো চলে এসেছে আমাকে নিতে। নিশ্চয়ই সে নিচে দাঁড়িয়ে আছে আমার জন্য, কাপড়চোপড় টুকটাক রাতেই গুছিয়ে রেখেছি। কোনরকমে হাতমুখ ধুয়ে ব্যাগ নিয়ে বের হলাম, মা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

পিছন থেকে বারবার ডাকছে আমি শুধু বললাম, নিজের সিদ্ধান্তটা নিজে একটু নেবো।

নিচে এসে সবচেয়ে বড় ধাক্কা লেগেছে, সাজ্জাদ আসেনি। ভোরবেলা এসে একটা চিঠি রেখে গেছে, দারোয়ান কাকা সেটাই দেবার জন্য আমার খোঁজ করছেন।

তেমন কিছু লেখা নেই, শুধু লেখা আছেঃ-

” অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল ব্যস্ত শহর ছেড়ে কোন এক নদীর চরে কিংবা জঙ্গলে ঘুরে বেড়াবো। আজ সেই ইচ্ছে পুরণ করার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম, বাসার সবকিছু তোমার নিজের হাতে গড়া। সেগুলো তুমি গ্রহণ করে নিও, একটাই আফসোস ‘ তুমি কেন আমার সঙ্গে এমনটা করলে সেই উত্তরটা জানতে পারি নাই। ”

– মা আমার হাত ধরে বললো ” আমি তো ইচ্ছে করে সাজ্জাদকে নির্লজ্জ বলিনি, রাগের মাথায় বলে ফেলেছি। তুই বাড়ি ছেড়ে যাসনে শাকিলা, সাজ্জাদ ঠিকই ফিরে আসবে। ”

– আমি ঠান্ডা মাথায় বললাম, ” সে ফিরে আসুক বা না আসুক, আমি তোমাদের বাড়িতে আর এক মুহূর্তও থাকবো না মা। তোমরা মা-বাবার দিকে তাকিয়ে আমি ওর সঙ্গে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি। ”

– সেখানে একা একা কি করবি? তারচেয়ে বরং আমাদের সঙ্গে থাক, ও ফিরে এলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।

– মা তুমি আমকে এমন কোন অনুরোধ করিও না যেটা রক্ষা করতে পারবো না। বাবা বাসায় এলে তাকে বলে দিও আমার বাসায় যেন ভুলেও না যায়। ভুল করে যদি রাস্তায় কোনদিন দেখা হয়ে যায় সেদিন যেন মেয়ে বলে পরিচয় দিতে না আসে। কারণ সে কিছু বললেও আমি কিন্তু তাকে না চেনার ভান করে এড়িয়ে যাবো।

– এসব কি বলছিস তুই? নিজের মা-বাবার সঙ্গে এসব কথা বলতে পারলি তুই? আমরা কি তোর কেউ না শাকিলা?

– ঠিক এই কথা মা, ঠিক এই কথা বলে সেদিন তুমি আর বাবা আমার মুখে তালা দিয়েছো। আমি সাজ্জাদের মতো একটা ছেলেকে বিনা কারণে অবহেলা আর অপমান করে চলে এসেছি। মাগো আমার কি দোষ? সাজ্জাদের কি দোষ?

– তোর স্বামীর কোন দোষ নেই?

– না নেই, আমার স্বামীর কোন দোষ নেই। যত দোষ সব তোমার স্বামীর মা, তোমার স্বামীর সকল দোষ। শুধু মা-বাবা বলে অন্যায় জেনেও সাজ্জাদ কে আমি দুরে রাখতে গেলাম। কিন্তু আর না, যদি সারাজীবন ওই বাসায় একা একা পার করতে হয় তবুও আর ফিরবো না।

– পাগল হয়ে গেছিস? কি বলিস এসব?

– ঠিকই বলছি, এগুলো অনেক আগেই দরকার ছিল বলার। মানুষ জাতি বড় অদ্ভুত মা ” সঠিক সময়ে সঠিক কাজটা করতে কেউ চায় না, কিন্তু পড়ে সব হারিয়ে বেঠিক সময়ে অনেক বাসনা ও যন্ত্রণা নিয়ে আফসোস করে। ”

নিজের ব্যবহৃত সবকিছু নিয়েই বাড়ি ত্যাগ করে রাস্তায় বের হলাম। আমার ছোটবোন আমার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তা পর্যন্ত এসেছে, একটা রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছি। আমার বোনের নাম সুমনা, সুমনা আমার চেয়ে দুই বছরের ছোট।

– সুমনা বললো, আপু আমি যদি মাঝে মাঝে তোমার সঙ্গে দেখা করতে যাই তাহলে আমাকেও কি পরিচয় দেবে না?

– তোর কথা আলাদা, তবে আমার কাছে গিয়ে কি করবি তুই? পড়াশোনা ভালো করে কর, আর তুই সবসময় মা-বাবার কথা বিবেচনা করে কাজ করবি। হুট করে তাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে পড়ে আমার মতো আফসোস করবি না।

– ঠিক আছে আপু, যদি আমার কোন সিদ্ধান্ত নিতে বা বুঝতে সমস্যা হয় তাহলে তোমার সঙ্গে আলাপ করবো।

– কোন দরকার নেই, তখন বাবা বলবে আমার বুদ্ধিতে তুইও বদলে গেছো।

– আচ্ছা ঠিক আছে আমিই ভেবে নেবো।

– এখন বাসায় যা।

– আপু?

– বল।

– আমার মন বলছে তুমি বাসায় গিয়ে দুলাভাইকে পাবে, গিয়ে দেখবে সে তোমার জন্য রান্না করে বসে অপেক্ষা করছে।

– কিন্তু বাসার সবগুলো চাবি আমার কাছে।

– সে নিশ্চয়ই নতুন চাবি বানিয়েছে, তোমাকে নেবার জন্য এমন বুদ্ধি করেছে।

– তাই যদি হয় তাহলে তোকে আমি বাসায় নিয়ে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াবো।

– সত্যি তো আপু?

– সত্যি সত্যি সত্যি।

– তাহলে দেরি না করে চলে যাও, গিয়ে দেখো তোমার জামাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।

বাসায় তালা ঝুলছে, সুমনার কথা শুনে আমি সত্যি সত্যি ধরে নিয়েছিলাম সাজ্জাদকে বাসায় পাবো। অনেকটা আশাহত হয়ে দরজা খুলে প্রবেশ করলাম, চারিদিকে তাকিয়ে কেমন ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছে। সবকিছু খুব সুন্দর করে সাজানো আছে, সাজ্জাদ গোছালো জীবন পছন্দ করে। বিয়ের আগে থেকে সে এই ফ্ল্যাট ভাড়া করে একা একা থাকতো। সাধারণ আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে বিয়ের পড়ে যখন এ বাড়িতে এসেছিলাম সেদিন বেশ মুগ্ধ হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম বিয়ের জন্য হয়তো এতটা সাজানো, কিন্তু এরপর ঠিক যতগুলো দিন পেরিয়ে গেছে তার মধ্যে কোনদিন অগোছালো দেখিনি।

রান্না ঘরে গিয়ে চুলো ধরিয়ে চায়ের জন্য গরম পানি দিলাম। বাসার প্রতিটি রুমের মধ্যে হাঁটলাম, কেমন ছমছম করছে। এর আগেও এভাবে ফাঁকা বাসায় একা একা দিনের পড় দিন পার করেছি। তখনও খারাপ লাগতো, কিন্তু দিনশেষে সাজ্জাদ বাসায় ফিরবে এই কথাটা মনের মধ্যে গাঁথা ছিল।

চায়ের কাপ নিয়ে বেলকনিতে বসে আছি, হাতের মধ্যে সাজ্জাদের লেখা সেই চিঠি। চিঠির শেষের কথাটা যেন বারবার প্রশ্ন করে আমাকে, সাজ্জাদ বলেছে ” তুমি কেন এমন করলে সেটাই জানতে পারলাম না। ”

রুমের মধ্যে গিয়ে হঠাৎ করে নজরে গেল সাজ্জাদ তার অফিস আইডি কার্ড যেখানে রাখতো সেখানে কার্ড নেই। আমাদের বিবাহিত সংসার জীবনে কোনদিন সাজ্জাদকে এই আয়নার সামনে ছাড়া কার্ড রাখতে দেখিনি।
বাসা থেকে বের হলাম, গন্তব্য সাজ্জাদের অফিস। সেখানে গিয়ে খোঁজ নিতে হবে, যেহেতু অফিসের আইডি কার্ড বাসায় নেই।

অফিসে গিয়ে গেট দিয়ে ঢুকতেই সিকিউরিটিকে জিজ্ঞেস করলাম। লোকটাকে আমি চিনি, তার মেয়ের বিয়ের সময় সাজ্জাদের সঙ্গে আমি তার বাসায় গেছিলাম।

– আঙ্কেল কেমন আছেন?

– আলহামদুলিল্লাহ ভালো মা, আপনি সাজ্জাদ স্যারের বউ না?

– জ্বি আঙ্কেল, আঙ্কেল সাজ্জাদ কি অফিসে?

– হ্যাঁ এসেছিল, ঘন্টা খানিক আগে বের হয়েছে।

– বলেন কি? আবার কখন আসবে?

– জানি না, তিনি তো অনেক সময় এভাবে চলে যায়, কখনো দেরিতে আসে আবার কখনো কখনো তাড়াতাড়ি।

– ভিতরে গেলে জানতে পারবো? সজীব ভাই কি অফিসে আছে?

– হ্যাঁ, সজীব স্যার আছে।

– ঠিক আছে আমি যাচ্ছি তাহলে।

সাজ্জাদের অফিসের মধ্যে সবচেয়ে ভালো বন্ধু হচ্ছে সজীব ভাই, দুজনে একই সেকশনে কাজ করে। তিনি প্রায়ই সাজ্জাদের সঙ্গে আমাদের বাসায় যেতেন, তার গ্রামের বাড়ি বাগেরহাট।

– আরে ভাবি আপনি? অসুস্থ শরীর নিয়ে আপনি কেন কষ্ট করতে গেলেন? আমি তো ছুটির পড়ে আপনার বাসায় গিয়ে আপনার পার্সেল দিয়ে আসতাম।

আমি অবাক হলাম, মনে মনে ভাবলাম কিসের পার্সেল? কে দিয়েছে?

– বললাম, সাজ্জাদ কোথায় সজীব ভাই?

– মানে কি ভাবি? সাজ্জাদ বললো সাজ্জাদের কোন আত্মীয় নাকি অসুস্থ তাই সেখানে যাবে। ফিরতে দুদিন দেরি হবে আর আপনি নাকি তার সবকিছু জানেন। আপনি অসুস্থ তাই আপনাকে নিয়ে যেতে পারছে না।

আমি তখন এক এক করে বিগত দিনের সবকিছু সজীব ভাইকে বললাম। সব শুনে তিনি আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন, মনে হয় তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। কারণ সাজ্জাদ যেহেতু তার খুব ভালো বন্ধু তাই এই বিষয়গুলো অন্তত তার সঙ্গে শেয়ার করবে এটা তার ধারণা ছিল।

– সজীব ভাই বললো, ভাবি আমি যদি একটু হলেও বুঝতে পারতাম তাহলে কোনদিনই তাকে যেতে দিতাম না।

– আপনি বলেন না ওকে কোথায় পাওয়া যাবে?

– জানি না, তবে আমার বিশ্বাস সাজ্জাদ দ্রুত ফিরে আসবে। সাজ্জাদ কিন্তু আপনাকে প্রচুর ভালোবাসে ভাবি, আপনাকে ছেড়ে থাকতে পারা অসম্ভব তার কাছে।

– আমিও জানি, কিন্তু ভয়টা অন্য যায়গা ভাই।

– কোন যায়গা?

– ও কখনো আমার সঙ্গে রাগ করতো না, আমি যদিও ভুল করতাম না। তবুও সামান্য কিছু হলেও কখনো রাগতো না, কিন্তু আজ যেহেতু এতকিছু হয়ে গেছে তখন ভয় হচ্ছে খুব।

আমি আর কথা না বাড়িয়ে সজীব ভাইয়ের কাছ থেকে পার্সেল নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। তারপর আসি বলে পিছনে ফিরে হাঁটা শুরু করেছি, সজীব ভাই পিছন থেকে বললো,।

– একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি ভাবি?

– আমি ঘাড় ফিরিয়ে মুখে কিছু না বলে তার দিকে জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।

– আপনিও তো সাজ্জাদকে খুব ভালোবাসতেন তাই না?

– আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, হ্যাঁ।

– তাহলে আপনি কেন বদলে গেলেন? সাজ্জাদ এর মতো আমারও জানতে ইচ্ছে করছে। তাছাড়া আপনার এমনটা করার কারণ জানতে পারলে বুঝতে সুবিধা হতো সে ফিরবে কি ফিরবে না।

– আরেকদিন বলবো সজীব ভাই, ভাববেন না এড়িয়ে যাচ্ছি। আরেকদিন সত্যিই আপনাকে বলবো সবকিছু।

বাসায় ফিরে আমি সবচেয়ে বেশি অবাক হয়ে গেলাম, কেন যেন বারবার মনে হচ্ছে বাসায় কেউ প্রবেশ করেছিল। বেলকনিতে বসে চা খেয়ে আমি সেখানেই চেয়ার রেখে গেছিলাম, চেয়ারের উপর খালি কাপ ছিল। কিন্তু চেয়ার এখন ভিতরে, আর কাপটা রান্না ঘরে রাখা।

পার্সেলের মধ্যে একটা চেকবই, সবগুলো পাতায় সিগনেচার করা। সঙ্গে একটা চিঠি, চিঠিতে মাত্র কিছু লাইন।

” আমার যতটুকু দরকার তা সঙ্গে করে নিলাম, বাকিটা তোমার জন্য রেখে গেলাম। সজীব খুব বিশ্বস্ত তাই ওর হাতেই রেখে গেলাম, যখন দ্বিতীয় বিয়ে করবে তখন নিজেকে ডিভোর্সি বলবে না। বলবে তোমার স্বামী মারা গেছে, কারণ এই সমাজ ডিভোর্সি শুনলে নিচু চোখে দেখে। ”

কতক্ষণ কান্না করেছি জানি না, কান্না করতে করতে কখন ঘুমিয়েছি তাও জানি না। যখন চোখ মেলে তাকালাম তখন চারিদিকে অন্ধকার আর অন্ধকার।

বাতি জ্বালিয়ে ফ্রেশ হলাম, সবকিছু কেমন যেন ভুতুড়ে মনে হচ্ছে। কখনো এতো রাতে একা একা ছিলাম না বাসায়, যেদিন সাজ্জাদের বাসায় ফিরতে দেরি হতো সেদিন আগেই বাড়িওয়ালার কাছে কল দিয়ে তার মেয়েকে আসতে বলতো।

বিছানায় আমার মোবাইল পড়ে আছে, সেটা হাতে নিয়ে দেখি ছোটবোন সুমনা অনেকবার কল করেছে। এতবার কল দেবার কারণ বুঝতে পারছি না, হয়তো বাবা বাসায় ফিরে রাগারাগি করেছে। কিংবা কল দিয়ে বলবে ” আপু তুমি হঠাৎ করে চলে গেছ আমার একা একা ভালো লাগে না। ”

– কলব্যাক করলাম, সঙ্গে সঙ্গে সুমনা রিসিভ করে বললো ” কল দিলাম রিসিভ করো না কেন? ”

– ঘুমাচ্ছিলাম, বল এখন।

– আপু দুলাভাই তো নোয়াখালী চলে গেছে।

– আমি আৎকে উঠে বললাম ” কে বলেছে? ”

– ফেসবুকে একটা ছেলে তার ছবি পোস্ট করেছে, আর তিনি বাসের ভিতরে ছিলেন। তার পাশের সিটেই দুলাভাই বসে ছিল, সেই ছেলেটা ক্যাপশন দিয়ে লিখেছেন ” চমৎকার একটা মানুষের সঙ্গে এবার ভ্রমণ করলাম, জীবনের স্মরণীয় একটা ভ্রমণ করলাম। ”

– সেই ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করার ব্যবস্থা কি?

– আমি যোগাযোগ করেছি, তার মোবাইল নাম্বার ও রেখেছি। তুমি এক কাজ করো, তাকে কল দিয়ে শুধু বলবা তোমার নাম শাকিলা। আমি তাকে সবকিছু বলছি, সুমনার বোন বললেই চিনবে।

নাম্বার নিয়ে কল দিলাম, এখন রাত দশটা পার হয়ে গেছে। আরও আগে সুমনার কল রিসিভ করতে পারলে খুব ভালো হতো।

– হ্যালো আসসালামু আলাইকুম।

– ওয়া আলাইকুম আসসালাম, ভাইয়া আমি সুমনার বোন শাকিলা। সুমনা নামের কোন মেয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে আপনার?

– জ্বি আপু।

– ভাই সাজ্জাদ কোথায়?

– আপু সেই ভাইয়াটা দুধমুখা বাজার নেমে গেছে আর আমি এসেছি বসুরহাট। বাস থেকে নামার কিছুক্ষণ পরই আপনার বোনের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আরেকটু আগে যদি কথা হতো তাহলে তো তাকে আমি অনুসরণ করতাম বা বিভিন্ন অজুহাতে নিজের বাসায় নিয়ে আসতাম।

– আমি তো ভাই নোয়াখালী কখনো যাইনি, তাই কিছু চিনি না। সেখানে সে কোথায় কার বাসায় যাবে সেগুলো কিছু বলেছে?

– বললো তার অনেক আগের পরিচিত কে যেন আছে, তার সঙ্গে দেখা করে তিনি আবার নাকি ভোলা চরফ্যাশন চলে যাবেন। তারপর সেখান থেকে চলে যাবেন মণপুরা দ্বীপে।

কুয়াশার মতো পর্বঃ- ০২

– আপনি কি জানেন সাজ্জাদ কোন গ্রামে যাবে, বা কোন এলাকায়?

– মোহাম্মদনগর গ্রাম, এতটুকুই জিজ্ঞেস করেছি। প্রয়োজন নেই তাই আর বিস্তারিত কিছু জানতে চাই নাই।

– আমি যদি কালকে সকালে উঠে নোয়াখালীতে আসি তাহলে আপনি কি আমাকে একটু সাহায্য করতে পারবেন ভাই?

– জ্বি আপু চেষ্টা করবো, কিন্তু অপরিচিত এখানে আপনি একা একা আসতে পারবেন?

– আমি আমার পরিচিত কোন বন্ধু নিয়ে আসবো, নাহলে আমার বোনকে সাথে নিয়ে আসবো।

– ঠিক আছে চলে আসুন, আমি যতদূর পারি সেই ভাইয়াকে খুঁজে বের করতে চেষ্টা করবো।

– আচ্ছা ঠিক আছে ভাই।

রান্না ঘরের মধ্যে বিশাল একটা শব্দ হলো, সমস্ত ফ্ল্যাট কাঁপিয়ে আওয়াজ শোনা গেল। রাতের এই নিস্তব্ধ পরিবেশে কেমন যেন ভয় করতে লাগলো। রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম, একটা কালো বিড়াল দৌড়ে বের হয়ে গেল। আশ্চর্য, এখন এই বিড়াল কীভাবে এসেছে?

সাজ্জাদের বন্ধু সজীব ভাইকে কল দিলাম, এতো রাতে বিরক্ত করতাম না। কিন্তু যেহেতু তিনি বিয়ে করেননি তাই সমস্যা হবে না, কেননা তার বিয়ে হলে এতো রাতে একটা মেয়ে হয়ে কল দিতে সাহস পেতাম না।

– আসসালামু আলাইকুম ভাবি!

– ওয়া আলাইকুম আসসালাম, সজীব ভাই আমি দুঃখিত বিরক্ত করার জন্য।

– ছি ছি লজ্জা দিচ্ছেন কেন? আমিই কল দিতাম কিছুক্ষণ পড়ে। বাসায় ফিরতে দেরি হয়ে গেছে ভাবি, সাজ্জাদ নেই তাই সবকিছু আমাকেই করা লাগে। সাজ্জাদ যখন ছিল তখন সারাদিন আমার তেমন কিছুই করতে হতো না। মুহূর্তের মধ্যে সে কীভাবে যেন সবকিছু করে ফেলতো, কাজের জন্য সাজ্জাদ সিনিয়র জুনিয়র সবার কাছে খুব প্রিয়।

– সাজ্জাদ নোয়াখালী গেছে সজীব ভাই।

– বলেন কি? কীভাবে জানলেন, আপনার সঙ্গে কথা হয়েছে সাজ্জাদের?

আমি সংক্ষিপ্ত করে সবকিছু বললাম। সজীব ভাই অবাক হয়ে গেল, তিনি হয়তো ধারণা করতে পারে নাই সাজ্জাদ এতদূর চলে গেছে।

” বললাম, সজীব ভাই আমি আগামীকাল সকালে উঠে নোয়াখালী যেতে যাই। আপনি আমার জন্য একটা ব্যবস্থা করে দিবেন, আপনি যেহেতু অফিস রেখে যেতে পারবেন না। নাহলে আপনাকেই সঙ্গে করে নিয়ে যেতাম সজীব ভাই। ”

” ঠিক আছে আমি ব্যবস্থা করবো, একাই যাবেন নাকি সঙ্গে কাউকে নিবেন? ”

” একাই যাবো, কতদিন কি লাগে তা তো জানি না আর সেখানে যদি কোনো সমস্যা হয়। তাই যা কিন্তু হোক সেটা আমি একাই ভোগ করতে চাই, কাউকে নেবো না। ”

” ঠিক আছে, সমস্যা হলে আমি তো আছি, কোন বিপদ হলে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানাবেন। ”

কল দিয়ে বিছানায় বসে ভাবছি, আজকের রাতটা পার করতে কতটা কষ্ট হবে জানি না। অপেক্ষার রাত হয়তো অনেক দীর্ঘ হয়, কিন্তু সেই অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে যদি ভালো কিছু পাওয়া যায় তবে আফসোস থাকে না।
মোবাইলে সুমনা কল দিয়েছে।

” আপু অনেকক্ষণ ধরে তোমার নাম্বার ব্যস্ত পাচ্ছি কেন, কি করো তুমি? ”

” সেই নোয়াখালীতে কথা বললাম, তারপর তোর দুলাভাইয়ের বন্ধুর সাথে কথা বললাম। ”

” আপু বাসায় তো বিশাল কান্ড, বাবা বাসায় এসে দেখে তুমি বাসায় নেই। তারপর যখন তোমার চলে যাবার কথা শুনেছে তখন সঙ্গে সঙ্গে রাগ করে চলে গেছে তোমার বাসার দিকে। এতক্ষণে হয়তো পৌঁছে যাবার কথা, বাবার সঙ্গে অনেক হিসাব করে কথা বলবে। তুমি কিছুতেই আসবে না, আমি তোমাকে কিছু গোপন কথা বলবো। দুলাভাইকে বাবা একদম সহ্য করতে পারে না এর পিছনে খুব বড় ধরনের কারণ আছে। ”

” কি কারণ? ”

” সাক্ষাতে বলবো, তুমি আপাতত বাবাকে কি কি বলবে সেটা সাজিয়ে রাখো। ”

” আচ্ছা। ”

কল কাটতেই কলিং বেল বেজে উঠল, দরজার ছিদ্র দিয়ে বাবাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমি আস্তে আস্তে দরজা খুলে দিলাম। রুমের মধ্যে প্রবেশ করেই বাবা বললো,

” এসব কি ধরনের আচরণ শাকিলা? নিজে যা ইচ্ছে তাই শুরু করেছো? ”

” বাবা উত্তেজিত হবার মতো কিছু হয়নি, আমার বাসায় আসার ব্যাপারে তোমাকে নিষেধ করেছি। মা তোমাকে বলেনি কিছু? ”

” তুই নিষেধ করলে শুনবো নাকি? আমি তোকে জন্ম দিয়েছি নাকি তুই আমাকে জন্ম দিয়েছ? ”

” বাবা তুমি কিন্তু স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছো না, আমি কোথাও যাবো না। তুমি নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে এখান থেকে চলে যাও, নাহলে…! ”

” নাহলে কি? তুই জানিস তোদের ডিভোর্সের সবকিছু ঠিক করা হয়েছে। সাজ্জাদের মতো এক ছোটলোকের চেয়ে অনেক ভালো পরিবারে তোর বিয়ের কথাও চলছে অলরেডি। ”

” আমি সামান্য হাসলাম। ”

” হাসলি কেন? মজা লাগে আমার কথা? আমার যে অপমান হবে সেটা উপভোগ করতে খুব মজা লাগবে তাই না? ”

” বাবা শোনো, ‘কোথাও কেউ নেই’ উপন্যাসের মধ্যে মুনা তার মামাতো বোন বকুললে একবার বলেছিল ” পৃথিবীতে অনেক খারাপ পুরুষ আছে কিন্তু একটাও খারাপ বাবা নেই। ”

” তো কি হয়েছে? ”

” তুমি নিজেই নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করে দেখো তো, পৃথিবীতে যদি ভালো বাবাদের লিস্ট করা হয় তাহলে সেখানে তোমার নাম পাবে? ”

” তোর কি ধারণা আমি খুব খারাপ বাবা? ”

” হ্যাঁ কিছুটা। ”

” কেন, কি করেছি আমি? তোর সুখের জন্য সব করতে পারি সেজন্য অপরাধী আমি? ”

” আমার সুখের জন্য মানে? বলো যে তোমার স্বার্থ হাসিলের জন্য তুমি আমাকে ব্যবহার করেছো। নিজের স্বার্থের জন্য তুমি আমাকে ব্যবহার করে উপরে উঠতে চাও বাবা। ”

” কি বলতে চাস তুই? ”

” সাজ্জাদের সঙ্গে তুমি আমার বিয়ে দিয়েছিলে কারণ তোমার অনেক অফিশিয়ালি দুনম্বরি কাজ করাতে পারবে বলে। কিন্তু বিয়ের পড়ে যখন তুমি দেখতে পেলে সাজ্জাদ আত্মীয়স্বজনের চেয়েও সৎ থাকাটা গুরুত্ব দেয়৷ তখন তুমি আফসোসে পুড়তে লাগলে, তারপর থেকে তুমি আমাদের আলাদা করার ব্যবস্থা করতে চেষ্টা করলে। ”

” ফালতু কথা একদম বলবি না। ”

” তুমি এখন আবার আমার বিয়ে ঠিক করছো, নিশ্চয়ই সেখানে আরও বড় স্বার্থ আছে। ”

” সাজ্জাদের বাচ্চা তোর মগজটা একদম নষ্ট করে দিয়েছে, ওকে যদি একবার হাতের কাছে পাই তবে খুন করে দেবো। ”

” সাজ্জাদের বাচ্চা নয়, সাজ্জাদ। সাজ্জাদের কিন্তু এখনো বাচ্চা হয়নি, যদি হয় তাহলে তুমিও নানা হতে পারবে। ”

” রাগে শরীর জ্বলছে তুই মজা নিস? ”

” মোটেই না, সত্যি বললাম। ”

” আমিও সত্যিই বলছি, ওকে যদি আমি চোখের সামনে পাই তাহলে খুন করে দেবো। আমার অনেক ক্ষতি করেছে ও, ভেবেছিলাম তোকে ওর থেকে ডিভোর্স করিয়ে তারপর একটা বড় ধরনের ব্যবস্থা করবো। কিন্তু এখন তো তার আগেই করা দরকার, তোকেও সে কেড়ে নিয়েছে। ”

বাবা গজগজ করতে করতে বের হয়ে যাচ্ছে, আমি তার পিছনে পিছনে গিয়ে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে বললাম,

” মা’কে বলে দিও আমাকে ক্ষমা করতে। আর আজ থেকে যেন তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে তোমার হেদায়েতের জন্য দোয়া করে। ”

” কেন? ”

” তুমি শুধু এতটুকু বলে দিও। ”

বাবা চলে গেল, দরজা বন্ধ করে সুমনার কাছে কল দিয়ে মায়ের সঙ্গে কথা বলতে চাইলাম।

” মা বললো, কি ব্যাপার মা শাকিলা? তোর বাবা গেছে তোর ওখানে? ”

” হ্যাঁ এসেছিল আবার চলে গেছে, তোমাকে একটা কথা বলতে চাই মা। ”

” কি কথা? ”

” পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও শেষরাতে তাহাজ্জুদ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করো যেন সাজ্জাদের কোন ক্ষতি না হয়। ”

” কেন কি হয়েছে জামাইর? ”

” কিছু হয়নি, তবে তোমার স্বামী মানে আমার জন্মদাতা বাবা ওকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে গেছে। ”

” বলিস কি? আমি বলেছিলাম তোর বাবার কথা শোন, এখন আবার আগুন জ্বলবে। ”

” মা তুমি শুধু তোমার স্বামীকে বোঝাও, নাহলে সাজ্জাদের যদি কোনকিছু হয়ে যায় তাহলে কিন্তু আমিও কাউকে ছাড়বো না। আল্লাহ না করুন, সাজ্জাদের কিছু হলে আমার মা-বাবার জন্য আমি দুই ধরনের সাদা কাপড়ের ব্যবস্থা করবো। ”

” মানে কি শাকিলা? ”

” মানে খুব সহজ মা, বাবার জন্য সাদা কাফনের কাপড় আর তোমার জন্য সাদা বিধবা শাড়ি। ”

” শাকিলা…? পাগল হয়ে গেছো? ”

” চিৎকার করে লাভ নেই মা, সেদিন তুমি মা হয়ে আমার পা ধরে কেঁদেছিলে বলেই এতদিন অনেক কিছু অন্যায় জেনেও চুপচাপ ছিলাম। কিন্তু মা, এভাবে চুপচাপ থাকলে দিনদিন অপরাধ আর পাপের বোঝা শুধু বাড়বে। তারচেয়ে বরং এবার সবকিছুর নিষ্পত্তি হোক, হয় তোমার স্বামীর সব অপরাধ জিতবে। নাহয় আমি হেরে গিয়ে পৃথিবী থেকে হারাবো, কিন্তু এর শেষ দেখতে চাই। ”

” শাকিলা? ”

” আমাকে নয়, আল্লাহকে ডাকো। ”

কুয়াশার মতো পর্বঃ- ০৩

সকাল বেলা সাজ্জাদের কিছু ছবি পাঠিয়ে দিলাম সেই ছেলেটার কাছে। ছেলেটা নিজেই সকালে আমাকে কল দিয়ে বললো,

” আপু আপনি চাইলে আমি আজকেই চেষ্টা করে তাকে খুঁজে বের করি, আপনি ঢাকা থেকে আসুন আমি তারমধ্যে দুধমুখা বাজারে গিয়ে সবার সঙ্গে জিজ্ঞেস করি। ”

” বললাম, না ভাই এতটা কষ্ট করতে হবে না, আপনি এমনিতেই অনেক উপকার করেছেন। আমি একটু পড়ে রওনা দেবো, সেখানে গেলে আমি আপনাকে স্মরণ করবো। ”

” সমস্যা নেই আপু, গতকাল রাতে আপনার সঙ্গে কথা হবার পড়ে আপনার ছোটবোনের সঙ্গে আমি আবার কথা বলেছিলাম। আপনি ভাইয়াকে খুব ভালোবাসেন, ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারছি সেও আপনাকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু একজনের সামান্য অবহেলা আর তার জন্য অন্য জনের একরাশ অভিমানে একটা সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে এটা কীভাবে সহ্য করবো? ”

” আপনার কাছে আমার বোন সবকিছু বলেছে তাই না? ”

” জ্বি আপু, আপনার বোনকে কিছু বলবেন না দয়া করে কারণ কারো ব্যক্তিগত বিষয় অপরিচিত হয়ে এভাবে শোনা ঠিক না। ”

” আমি কোথায় গিয়ে নামলে আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারবো? ”

” আপনি বসুরহাটের টিকিট সংগ্রহ করবেন, আর সেখানেই নামবেন। আপনার সঙ্গে আর কে কে আসবে? ”

” হয়তো আমি একাই যাবো, সঙ্গে কাউকে নিতে চাই না, ব্যক্তিগত সমস্যা আছে। ”

” কোন সমস্যা নেই, ছোট ভাইয়ের উপর বিশ্বাস করে চলে আসুন। আমি গতকাল রাতেই আমার মা-বাবার কাছে আপনাদের সবকিছু বলছি। তারা খুব আফসোস করেছেন, আপনি সরাসরি আমার বাড়িতে আসতে পারবেন। ”

” সেটা হবে না ভাই, আমি কারো বাসায় যেতে চাই না, ভালো কোনো হোটেল কিংবা ওকে খুঁজে না পেলে আবার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা ফিরে আসবো। ”

” আচ্ছা আগে আসুন তারপর দেখা যাবে, হয়তো অপরিচিত তাই বিশ্বাস করতে পারছেন না। সত্যি বলতে, আপনার বোনের কাছে শুনে যতটা বুঝতে পারছি তাতে মনে হচ্ছে আপনি আমার একমাত্র বড় আপুর বয়সী। আমার আপুর ও বিয়ে হয়েছিল কিন্তু সাংসারিক ঝামেলা ছিল খুব, মাত্র ১৯ দিন আগে আমার আপু মারা গেছে। ”

” কি হয়েছিল তার? ”

” যদি দেখা হয় আর আপনার হাতে সময় থাকে তাহলে সবকিছু বলবো। আপনি সাবধানে আসেন আমি আপনার অপেক্ষায় রইলাম, আর এক্ষুনি দুধমুখা বাজারে গিয়ে খোঁজ নেবো। ”

” কীভাবে কি করবেন? ”

” বাজারের সকল সিএনজি ও রিক্সাওলাকে ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করবো। তারপর নাহলে সেই মোহাম্মদ নগর গ্রামের মধ্যে যাবো, একটা সুস্থ মানুষ অবশ্যই পাওয়া যাবে। ”

‘অবশ্যই পাওয়া যাবে’ এই বাক্যটা শুনে আমার বুকটা কেঁপে উঠল, চোখ দিয়ে অজান্তেই পানি বের হয়ে গেল। আমি কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললাম,

” তাই যেন হয় ভাই, এই বোনের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ করে দিও। আমি যে অন্যায় তার সঙ্গে করেছি সেটা যে আমাকেই সমাধান করতে হবে ভাই। ”

” আপনি আসেন আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি, ইনশা- আল্লাহ খুঁজে পাবো। আপনি কাঁদবেন না আপু। ”

সজীব ভাই আমাকে বাসে উঠিয়ে দিয়ে টিকিট হাতে দিয়ে বললো,

” সাবধানে থাকবেন ভাবি, অপরিচিত স্থান তাই সবকিছু দেখে নিবেন। আর আপনাকে যে মেয়ের নাম্বার দিলাম তার বাসা নোয়াখালী সদরে। ”

” কিন্তু আমি তো বসুরহাট যাবো। ”

” সমস্যা নেই ভাবি, আপনি সেখানে কাজ শেষ করে সাজ্জাদকে পান বা না পান তবুও আশেপাশে পরিচিত কেউ নেই। তাই দিনশেষে যেন সেখানে গিয়ে যেন থাকতে পারেন। ”

” ধন্যবাদ ভাই। ”

” আমি সবসময় কল দিয়ে খোঁজ নেবো, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। ”

” আচ্ছা ঠিক আছে! ”

কুমিল্লা হোটেল থেকে গাড়ি বের হতেই বসুরহাট থেকে সেই ছেলেটা কল দিল। এখনো নামটা জানা হয় নাই তাই রিসিভ করে বললাম,

” আমি এখনো আপনার নাম জানি না ভাই। ”

” আমার নাম ফেরদৌস আহমেদ, আমি আপনার ছোট হবো তাই তুমি করে বলবেন। ”

” কোনো খবর পেলে? ”

” হ্যাঁ আপু সেজন্য কল দিলাম, আপনি তাড়াতাড়ি চলে আসেন। একটা সিএনজি নিয়ে তিনি সেই গ্রামে গেছিলেন, ড্রাইভার তাকে যেখানে নামিয়ে দিয়েছে সেই স্থানটার নাম জেনে নিয়েছি। ”

” কার বাড়িতে গেছে, জানো কিছু? ”

” না আপু, যেখানে নেমেছেন সেখান থেকে নাকি সামনে একটা রাস্তা ছিল। সেই রাস্তা দিয়ে তিনি হেঁটে হেঁটে চলে গেছে, কিন্তু সমস্যা নেই কারণ সেখানে গিয়ে আশেপাশে খোঁজ নিলেই পাওয়া যাবে ইনশাহা-আল্লাহ। ”

” আমি তো কেবল কুমিল্লা পার হলাম, এখনো ঠিক কতক্ষণ লাগবে বুঝতে পারছি না। ”

” মোটামুটি বিকেল তিনটা বা সাড়ে তিনটার মধ্যে পৌঁছে যাবেন হয়তো। দিন থাকতে এলে বেশি ভালো হবে, আমি কিন্তু এখন সিএনজি নিয়ে সেই গ্রামের মধ্যে যাচ্ছি। ”

” শুকরিয়া ভাই। ”

” আমি সেখানে গিয়ে আশেপাশের সবার কাছে জিজ্ঞেস করে বের করবো। আপনি ফেনি মহিপাল স্টেশন এলে আমাকে জানাবেন, তাহলে আমি বসুরহাট বা দুধমুখা বাজারে দাঁড়াবো। ”

” আমি তো চিনি না মহিপাল। ”

” দেখবেন বাস থেকে যাত্রী নামবে সেখানে, আর নাহলে দেখবেন একটা ফ্লাইওভারের নিচ থেকে গাড়ি ডানদিকে মোড় নেবে। তখন রাস্তার পাশে দোকানে তাকিয়ে সাইনবোর্ডে লেখা পড়বেন। ”

” আচ্ছা। ”

৩ঃ৪০ মিনিটে আমি বসুরহাট বাসটার্মিনালে বাস থেকে নামলাম, আমি বাস থেকে নামতেই কালো শার্ট পরিহিত একটা ছেলে আমার সামনে এসে জিজ্ঞেস করলো,

” আপনি শাকিলা আপু, তাই না? ”

” হ্যাঁ, তুমি ফেরদৌস? ”

” জ্বি আপু, আসুন আমার সঙ্গে। ”

ফেরদৌস তার বাইকে স্টার্ট দিল, আমি সামান্য কৌতূহল বোধ করলাম। তখন সে বলেছিল যে সিএনজি নিয়ে সেই গ্রামের মধ্যে যাচ্ছে তাহলে বাইক নিয়ে গেল না কেন?

” আপু সাজ্জাদ ভাই যে বাড়িতে গেছে সেই বাড়ি আমি খুঁজে বের করেছি। ”

” সত্যি বলছো? এতক্ষণ কল দিয়ে বলোনি কেন? ”

” কারণ সাজ্জাদ ভাই নেই, তিনি নাকি সকাল বেলা চলে গেছে। আপনাকে বললে কষ্ট পাবেন বা আশাহত হবেন তাই বলিনি, তবে আমার বারবার মনে হচ্ছে সাজ্জাদ ভাই ওই বাড়িতে আছে। ”

” কেন? ”

” কারণ সবার আচরণ কেমন যেন মনে হলো আর আমি তার বিষয় কিছু জিজ্ঞেস করতেই তারা কেন যেন উত্তর দিতে চায় না। যেমন, জিজ্ঞেস করেছি তাদের সঙ্গে কিসের সম্পর্ক তার? ”

” কি বললেন তারা? ”

” ইনিয়েবিনিয়ে অনেক কিছু বললেন যার কিছু পরিষ্কার বুঝতে পারিনি। ”

বাইক থামলো।
আমরা দাঁড়িয়ে আছি কোম্পানিগঞ্জ থানার সামনে, নোয়াখালী।

” বললাম, এখানে কেন ফেরদৌস? ”

” আপনি একটা জিডি করবেন, আমার বড়মামা এখানের দারোগা। যদিও আমার পারিবারিক ভাবে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো না তবে মামা আমাকে আদর করে খুব। তার কাছে গিয়ে জিডি করতে হবে, সাজ্জাদ ভাইয়ের ছবি দেবেন আর আপনি তাকে খুঁজতে এসেছেন তার নিশ্চয়তা। ”

” মানে? ”

” মানে আপনার যদি কোন সমস্যা হয় তাহলে যেন সবকিছু পুলিশের জানা থাকে। ”

অনেকটা অপমানিত হলাম, ছেলেটাকে সামান্য অবিশ্বাস করাতে হয়তো এমনটা করেছে। চুপচাপ কথা না বলে সবকিছু ঠিক মতো গুছিয়ে আমরা বের হলাম। আমাদের সঙ্গে ফেরদৌসের দারোগা মামা নিজের বাইক নিয়ে যাচ্ছেন। এভাবে সম্পুর্ণ অপরিচিত কাউকে কেউ সাহায্য করতে পারে সেটা জানা ছিল না।

বাইক চলছে, ফেরদৌস বললো ” আমি আপনার জন্য এতকিছু কেন করছি জানেন আপু? ”

” কেন? ”

” আমার আপুটা মৃত্যুর আগে বারবার আমার কাছে সাহায্য চেয়েছিল। কিন্তু আপুর জীবনটা ছিল এমনই তাই সিরিয়াস নেইনি, কিন্তু যখন জানতে পেরেছি আপু মারা গেছে। তখন সবকিছু যেন নিজের ঘাড়ে অপরাধ চাপা পড়লো। ”

সাজ্জাদ সত্যি সত্যি নেই, দারোগার হুমকিতে তারা সবাই ভয় পেয়ে গেল। বাড়িটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে এরা অত্যন্ত গরীব, আমি তাদের অভয় দিয়ে বললাম,

” আমি সাজ্জাদের স্ত্রী, সাজ্জাদ রাগ করে ঢাকা থেকে চলে এসেছে। ওকে খুঁজে বের করা আমার জন্য জীবনের সবচেয়ে বড় কাজ এই মুহূর্তে। ”

এক মহিলা বললেন, ” মা সত্যি বলছি সাজ্জাদ চলে গেছে, সকাল বেলা উঠেই সে চলে গেছে। ”

” কোথায় যাবে কিছু জানেন? ”

” বলেছিল আবার ঢাকায় চলে যাবে। ”

” কি…? ঢাকায়? ”

” হ্যাঁ ”

” আপনাদের সঙ্গে ওর পরিচয় কীভাবে? ”

” সাজ্জাদ যখন ছোটো একটা চাকরি করতো তখন সে একটা সাহেবের ছেলেকে প্রাইভেট পড়াতো। সেই বাসায় আমি কাজ করতাম, আর সেখান থেকেই আমাদের পরিচয়। ”

” আশ্চর্য! ”

” আমার মেয়েটা পরীক্ষায় ভালো পাশ করেছিল তখন তাকে বলেছিলাম। সে বলেছিলাম একদিন গ্রামের বাড়িতে এসে আমার মেয়ের সঙ্গে দেখা করে যাবে। আমার কাছ থেকে খুব আগ্রহ করে ঠিকানা লিখে নিয়েছিল। ভেবেছিলাম সে কখনো আসবে না কিন্তু ৩/৪ বছর পড় হঠাৎ গতকাল রাতে যখন এসেছে তখন অবাক হয়ে গেছি। ”

আমার আর তেমন কিছু জানার ছিল না, আমি ফেরদৌসের সঙ্গে ক্লান্ত শরীরে তাদের বাসার দিকে রওনা দিলাম। দারোগা সাহেব বললেন কোন সমস্যা নেই আপনি আজকে রাতটা থেকে কালকে সকালে উঠে ঢাকা চলে যাবেন।

ফেরদৌসের বাসায় এসে সত্যিই অবাকের চেয়ে বেশি অবাক হলাম। তার মা-বাবা আমাকে অনেক আদর আপ্যায়ন করতে লাগলো, ঠিক যের তার নিজের মেয়ে আমি। কিন্তু আমরা তো বাঙালি, তাই অতিরিক্ত আদরের মধ্যে রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি।
কথায় বলে ” অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ “।

রাত এগারোটা।
আমাকে আলাদা রুমের মধ্যে ঘুমানোর ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। মোবাইল সাইলেন্ট করে ক্লান্তি আর কান্না নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সজীব ভাইয়ের সঙ্গে আগেই কথা হয়েছে, সাজ্জাদ যদি ঢাকা গিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে তাহলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে জানাবেন বলেছে।

পরদিন সকাল।
ঘুম থেকে উঠে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি অনেক গুলো মিসডকল। সুমনা, সজীব ভাই, অপরিচিত এমন অনেক নাম্বার দিয়ে কল এসেছে। আমি সবার আগে সজীব ভাইয়ের নাম্বারে কলব্যাক করলাম,

সজীব ভাই রিসিভ করে উৎকণ্ঠিত গলায় বলল,
” ভাবি আপনি কোন যায়গা?

” আমি তো নোয়াখালী সেই ফেরদৌসের বাসায়! ”

” সর্বনাশ হয়ে গেছে ভাবি। ”

” কি হয়েছে সজীব ভাই? ”

” আপনার বাসা থেকে কেউ কল করেনি? ”

” করেছে কিন্তু কথা হয়নি! ”

” গতকাল রাতে সাজ্জাদ আপনাদের বাসায় মানে আপনি আর সাজ্জাদ যেখানে থাকেন সেখানে আপনার বাবাকে খুন করেছে। আপনার বাবার লাশ পোস্টমর্টেম করতে নেওয়া হয়েছে আর সাজ্জাদও হাসপাতালে কারণ তাকে পাওয়া গেছে অজ্ঞান অবস্থায়। মাথায় একটা লোহার রড দিয়ে আঘাত করা হয়েছে, তবে পুলিশের ধারণা এটা সাজ্জাদ নিজে ইচ্ছে করে করেছে। আপনার বাবাকে খুন করে তারপর নিজেকে নিজে আঘাত করে অজ্ঞান হয়েছে। ”

” আমি হাউমাউ করে বললাম, কি বলছেন সজীব ভাই? এটা শোনার জন্য আমি বেঁচে আছি? ”

কুয়াশার মতো পর্বঃ- ০৪

” সাজ্জাদের অবস্থা বেশি ভালো না ভাবি, পুলিশ হাসপাতালেই তাকে পাহারা দিচ্ছে। আপনি আজ এখনই ঢাকায় আসেন, আর যা হবার তা তো হয়ে গেছে, আসার সময় নিজেকে শক্ত রাখবেন। ”

” সজীব ভাই আপনি কি অফিসে? ”

” হ্যাঁ ভাবি, কিছুক্ষণ আগে এসেছি। ”

” আমার বাসায় মা আর সুমনার এখন অবস্থা কি রকম? নিশ্চয়ই কান্না করে সবাই? ”

” তা তো করবেই ভাবি, আমি সকালে গেছিলাম আপনাদের বাসায়। তখন সেখানে অনেক মানুষ উপস্থিত ছিল, আপনার মা বেশি ইমোশনাল হয়ে গেছে। চিৎকার দিয়ে শুধু আপনাকে বকাবকি করে, আপনি নাকি সবকিছুর জন্য দায়ী। ”

” মা এখন কোথায়? ”

” তাকে বাসায় পাঠানো হয়েছে আর আপনাদের সেই ফ্ল্যাট পুলিশ লক করে দিয়েছে। বিভিন্ন তদন্ত করার জন্য কারো প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সেখানে। ”

ফেরদৌসের বাসায় তার মা-বাবা যখন আমার মুখে শুনলেন তখন সবাই হা হয়ে গেল। সকলের কাছে যেন অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা বর্ননা করেছি আমি তাই তারা নির্বাক।

আমি দ্রুত বের হবার প্রস্তুতি নিলাম, চোখ দিয়ে সেই তখন থেকে পানি বের হওয়া শুরু করেছে আর এখনো অনবরত চলেছে।

ফেরদৌস বললো ” আপু আমিও আপনার সঙ্গে যাবো। ”

” কেন? ”

” আপনি যেতে পারবেন না, পথে যদি নতুন কোন বিপদ হয় তাহলে তো সমস্যা হবে। ”

” আমার কিছু হবে না, তুমি বাড়িতে এসেছো তাই আমার জন্য এখন যেতে হবে না। ”

” আপনাকে দিয়ে আমি আবার আসবো। ”

অনেক চেষ্টা করেও একা বের হতে পারিনি, তাই ফেরদৌসকে সঙ্গে নিয়ে রওনা দিলাম। একটু পড়ে পড়ে বাবার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠবে বুঝতে পারিনি। সেদিন রাতে যদি বুঝতাম বাবার সঙ্গে আর কোনদিন দেখা হবে না। তাহলে এতটা খারাপ ব্যবহার করতাম না হয়তো, নিজেকে খুব অসহায় লাগে।

ঢাকায় পৌঁছে সরাসরি হাসপাতালে গেলাম। সজীব ভাই হাসপাতালের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে, তিনি কিছুক্ষণ আগেই এসেছেন। আমি তার সঙ্গে উপরে উঠলাম, ফেরদৌস আমার সঙ্গেই আছে।

সাজ্জাদ আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছে, তার সঙ্গে দেখা করে কোনো লাভ নেই। তাই বাহিরে এসে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলা জন্য বসে আছি, ভেবেছিলাম বাসার কাউকে হয়তো পাওয়া যাবে। বাসে করে আসার সময় সুমনার নাম্বারে কল দিছিলাম কিন্তু রিসিভ করে নাই।

” সজীব ভাই বললো, অনেক রক্ত বের হয়ে গেছে আর মাথার মধ্যে রক্ত জমেছে। একবার একটু জ্ঞান ফিরেছিল তারপর থেকে আবার অজ্ঞান হয়ে আছে। ”

” বললাম, পুলিশ কীভাবে খবর পেল? ”

” ফজরের নামাজ পড়ার জন্য আপনাদের ফ্ল্যাট এর উপরতলার একটা লোক মসজিদে যাচ্ছেন। তিনি সিঁড়ির চৌকিতে রক্তের দাগ দেখতে পান, তারপর বাড়িওয়ালাকে ডাকেন। দরজা খোলা ছিল তারা ভিতরে প্রবেশ করে দেখেন আপনার বাবা ছুরি পেটে বিদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। আর কাছেই সাজ্জাদ রক্তাক্ত মাথা নিয়ে শুয়ে আছে, সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ডাকা হলো। পুলিশ এসে চেক করে সাজ্জাদকে জীবিত ধারণা করে, আপনার বাবা মারা গেছে সেটা সেখানেই বোঝা গেছে। ”

” আমি কি আমার বাসায় যেতে পারবো? ”

” জানি না ভাবি, দারোগা সাহেব এলে তার কাছে জিজ্ঞেস করে জানতে হবে। ”

” বাবার লাশ কোথায়? ”

” পোস্টমর্টেম শেষ হয়ে গেছে, আপনার কাকারা এসেছেন তারা হয়তো লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাবেন। ”

” আমি এখনই যেতে চাই, এখানে তো সাজ্জাদের সঙ্গে ডাক্তার নার্স আছে। বাবাকে শেষ দেখা তো দেখতে হবে, খুব কষ্ট লাগছে সজীব ভাই। ”

” ভাবি একটা কথা। ”

” জ্বি বলেন। ”

” আপনাকে সাজ্জাদ যে চেকবই দিয়েছিল সেটা কি আপনার কাছে আছে? আমি কিন্তু জানতাম আপনার কাছে চেকবই আছে কিন্তু সকাল বেলা পুলিশ তল্লাশি করার সময় পাওয়া গেল না। ”

আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম ” বলেন কি? আমি তো সেটা আমাদের বেডরুমে বালিশের তলায় রেখে দিছিলাম। ”

” পুলিশ তো ভালো করে তল্লাশি করেছে তাহলে পেল না কেন? যদিও আমি চেকবইয়ের কথা কিছু বলিনি কিন্তু মনে মনে ছিল। কারণ আপনি সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন না সেটা ধারণা ছিল। ”

” তাহলে চেকবই কে নিয়েছে? ”

” তা তো জানি না ভাবি, আচ্ছা এটা পুলিশের কাছে বললেই ভালো হবে। খুনের সঙ্গে টাকার কোন সম্পর্ক থাকতে পারে। ”

” কিন্তু চেক বইয়ের কথা আপনি আমি সাজ্জাদ ছাড়া আর কেউ কি জানে? ”

” জানার কথা নয়। ”

” পুলিশ এগুলো বের করতে পারবে, আগে চলুন আপনার বাবার লাশ দেখবেন। ”

সজীব ভাইয়ের মুখটা হঠাৎ করে কেমন পরিবর্তন মনে হলো, নিজে একটু বিব্রত হয়ে গেছে।

হাসপাতাল থেকে বের হবো এমন সময় পুলিশের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ওসি সাহেব বললেন,

” কোথায় যাচ্ছেন, শাকিলা মেডাম? ”

” আমি বাবার লাশ দেখতে যাবো। ”

” আপনার বাবার লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে চলে গেছে, আপনাকে এখন আমাদের সঙ্গে থানায় যেতে হবে। ”

” আশ্চর্য হয়ে বললাম, মানে কি? ”

” সজীব ভাই বললো, কিন্তু কেন অফিসার? ”

” তার বাবার হত্যার দায়ে সাজ্জাদের সঙ্গে সঙ্গে তার নামেও মামলা করা হয়েছে। তার মা নিজেই মেয়ের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন, সুতরাং আপনার স্বামী যেহেতু অসুস্থ সেহেতু আপাতত আপনি আমাদের সঙ্গে চলুন। ”

” পাগল হয়েছেন আপনারা? আমার মা এখন শোকের আবহে কতকিছু বলবে আর তাই বলে আমাকে ধরে নিয়ে যাবেন? ”

” কিছু করার নেই, মামলায় আপনার নাম। ”

” আর সাজ্জাদ খুন করেছে সেকথা কীভাবে বলেন আপনারা? যে নিজেই আহত হয়ে এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে, তাকেও সন্দেহ? ”

” দেখুন আপনার স্বামী অভিনয় করছে, তিনি মনে হয় ভাবতে পারেননি রডের আঘাত বেশি জোরে লেগে যাবে। শশুরকে হত্যা করে নিজে হালকা অসুস্থ হবার জন্য একা একা আঘাত করেছেন। ”

” কিসের ভিত্তিতে বলছেন? ”

” সন্দেহের ভিত্তিতে, আমরা সবসময় সন্দেহ থেকে আসামির সনাক্ত করা শুরু করি। তারপর সেই তালিকা থেকেই খুনি বেরিয়ে আসে। ”

পুলিশের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে, বাবার লাশের সঙ্গে শেষ দেখা করতে না পেরে, মুমূর্ষু স্বামীকে হাসপাতালে রেখে আমি জেলে চলে এসেছি। সজীব ভাই প্রতিদিন দেখা করতে এসেছে কিন্তু আমার মা কিংবা বোন কেউ আসেনি। তারা নাকি এখনো গ্রামের বাড়িতে, এদিকে সাজ্জাদ এখনো কথা বলতে পারে না। আমি চারদেয়ালে বন্দি হয়ে সারাদিন সারারাত কান্না করে শুধু চোখে পানি বিসর্জন করা ছাড়া কিছু করতে পারি না। আল্লাহ কে বারবার বলছি, বাবাকে তো কেড়ে নিয়েছে, এবার আমার স্বামীকে যেন না নেয়।

সাজ্জাদ সুস্থ হলেও আরেক বিপদ, পুলিশ তখন তাকেও ধরে নিয়ে আসবে জেলে। মাঝে মাঝে আমারও কেমন সন্দেহ হয়, সত্যি সত্যি কি সাজ্জাদ আমার বাবাকে খুন করেছে?

সবকিছুর জন্য নিজেকে দায়ী মনে হয়, সেদিন রাতে আমি যদি এভাবে অপমান না করতাম। কিংবা সকাল বেলা বাসা থেকে বের না হতাম তবে কাহিনি এমন হতো না।

ফেরদৌস দিনের মধ্যে দুবার দেখা করতে আসে আমার সঙ্গে, গতকাল বললো একজন গোয়েন্দা তার পরিচিত আছে। আমি তাকে বলেছিলাম যে তাহলে কথা বলে নিয়ে আসো। সবকিছু চোখের সামনে কুয়াশার মতো মনে হয়, কুয়াশা যেমন অন্ধকার করে রাখে কিন্তু ছোঁয়া যায় না। তেমনি আমার সামনে মাত্র কয়েকদিনের ঘটিত জটিলতা কুয়াশার মতো লাগে। শাকিলার নিজের মুখের বর্ননা শেষ৷

হালকা অন্ধকার ঘরে বসে বসে এতক্ষণ ধরে সবকিছু শুনছিলেন সাজু ভাই। প্রায় দেড় ঘন্টা সময় লেগেছে শাকিলার মুখের বর্ননা শুনতে। সেদিন রাতে সাজ্জাদের সেই ড্রইং রুমে বসে থাকা হতে শুরু করে জেলে আসা পর্যন্ত সকল ঘটনা বলে হাঁপ ছেড়েছে শাকিলা।

” সাজু বললো, আপনার কষ্টের কথাগুলো বলে আরও কষ্ট পেয়েছেন বুঝতে পারছি। আমার কিছু তদন্তের জন্য সম্পুর্ণ ঘটনা জানার দরকার ছিল তাই জেনে নিলাম। কিন্তু আপনার বলা ঘটনার মধ্যে থেকে আমার বেশ কিছু প্রশ্ন আছে। ”

” জ্বি করতে পারেন, কিন্তু আপনাকে যেভাবেই হোক আমার বাবার আসল খুনি বের করতে হবে। আমি আমার স্বামীকে সন্দেহ করতে চাই না, কিন্তু আমার বাবার আসল খুনি ধরা পড়ুক সেটাই কামনা করি। ”

” প্রথম প্রশ্ন, আপনি বলেছেন আপনার বাসায় বেলকনিতে চেয়ার ও চায়ের কাপ কেউ মনে হয় রান্না ঘরে রেখেছে। এটা কি সত্যি? ”

” জ্বি, আমি অবাক খুব। ”

” পুলিশের কাছে আপনার যে ব্যাগ জমা আছে সেখানে আপনার বাসার চাবি পাওয়া গেছে। সেখানে আছে দুটো চাবি, সচারাচর একটা তালা ব্যবহারে তিনটা চাবি থাকে। ”

” আমাদের ও তিনটা চাবি ছিল। ”

” তাহলে আরেকটি চাবি কোথায়? ”

” আমি তো জানি না, সাজ্জাদ যখন চাবি রেখে গেছে তখন তো তিনটে চাবি ছিল। ”

” বুঝতে পারছি, আমি সেটা বের করে নেবো বা চেষ্টা করবো। দ্বিতীয় প্রশ্ন, ফেরদৌসের মা-বাবার কোন ঘটনা আপনি আমাকে বলেননি, আর সে তার বোনের কোনো কাহিনি কি বলেছিল? ”

” জ্বি বলেছিল। ”

” আচ্ছা সেটাও ফেরদৌসের কাছে জিজ্ঞেস করে জেনে নেবো। আপনার স্বামী চেকবই দিয়েছিল সেখানে মোট কত টাকা ছিল? ”

” সবমিলিয়ে ২০ লাখ টাকা হতে পারে, আসলে ততটা পরিষ্কার মনে নেই। ”

” তৃতীয় প্রশ্ন, আপনার বিয়ের আগে থেকে পছন্দ করে, খুব বেশি পছন্দ করে এমন কেউ আছে? ”

” হ্যাঁ, সানোয়ার হোসেন, আমার বন্ধু। ”

” সজীব সাহেবকে আপনার কেমন মনে হয়? তিনিও যে আপনাকে মনে মনে পছন্দ করে সেটা কখনো বুঝতে পেরেছেন আপনি? ”

” কোই না তো, কি বলেন? ”

” আচ্ছা বাদ দেন, আপনি সাবধানে থাকবেন আর দরকার হলে আবার আসবো। ”

” আমার মায়ের সঙ্গে একটু দেখা করবেন, আর তাকে বোঝাবেন সাজু ভাই। ”

” জ্বি অবশ্যই। ”

★★

ওসি সাহেবের সঙ্গে কথা বলে থানা থেকে বের হয়ে গেল সাজু, ফেরদৌস ও সাজ্জাদের বন্ধু সজীব সাহেব। ফেরদৌসকে সামনে হাঁটতে বলে সাজু একা একা সজীব সাহেবকে বললো,

” আপনার কাউকে সন্দেহ হয়? ”

” না সাজু ভাই, ব্যক্তিগত ঝামেলা নিয়ে সাজ্জাদ কোনদিন কিছু বলে নাই। ”

” আপনি আর সাজ্জাদ সাহেব দুজন মিলে যে অনলাইনে ছোট একটা বিজনেস করেন, সেটা কেমন চলছে এখন? সাজ্জাদ অসুস্থ, এদিকে এই পুলিশের ঝামেলা, সময় দিতে পারছেন তো? ”

” আপনি কীভাবে জানেন?

” আমিও আপনাদের ক্ষুদ্র ক্রেতা, সেখানে আমি আপনাদের দুই বন্ধুর এক লাইভ ভিডিও দেখেছি। ”

” ওহ্ আচ্ছা, চলছে মোটামুটি। ”

” মাঝে মাঝে আমরা সিনেমার মধ্যে দেখি, দুই বন্ধু একসঙ্গে ব্যবসা করে। হঠাৎ করে দুজনের মধ্যে একজনের মনের মধ্যে শয়তান বাসা বাঁধে এবং অপর বন্ধুকে সরানোর পরিকল্পনা করে। এমন কোন সিনেমা দেখেছেন? ”

” জ্বি… জ্বি..! ”

” এমন করছেন কেন? না দেখলে তো কোনো অপরাধ নেই তাই না? ”

” দেখা হয়নি তেমন, মনে নেই? ”

” শাকিলাকে আগে থেকে চিনতেন? ”

” কোই না তো! বিয়ের সময় প্রথম দেখা। ”

” আমি খুব দ্রুত কিছু তথ্য বের করেছি, সাজ্জাদ শাকিলা ও আপনার ব্যাপারে। বাকিদের সবকিছু আস্তে আস্তে বের করবো, তবে আমার স্বল্প সময়ে বের করা তথ্য অনুযায়ী আপনি শাকিলাকে আগে থেকে চিনতেন। ”

” কে বলেছে আপনাকে? ”

” এ বিষয়ে আগামী পরশু আপনার সঙ্গে কথা হবে আমার, আজকে আমি যাই। ”

” আপনি কি আমাকে সন্দেহ করেন? ”

” কি জানি ভাই, তথ্য অনুযায়ী যাকে যেটা বলা দরকার সেটাই বলি, তাতে যদি সন্দেহের তালিকা মনে হয় তাহলে তাই। ”

” আমি সাজ্জাদের সবচেয়ে ভালো বন্ধু। ”

” আমি ওসি সাহেবকে বলে দিয়েছি, আপনাকে আর হাসপাতালে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। ”

কুয়াশার মতো পর্বঃ- ০৫

” শাকিলা যখন তার বাবাকে খুন করার হুমকি দেয়, তার আগে আপনাদের মধ্যে ঠিক কি কথা হয়েছে জানতে পারি? ” প্রশ্ন করে উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে সাজু, তার পাশেই বসে আছে তার বন্ধু রামিশা।

” শাকিলার মা বললেন, সাজ্জাদের সঙ্গে সম্পর্ক আমরা রাখতে চাচ্ছিলাম না। শাকিলা নিজেও যেতে চায়নি তাই ওর বাবা তার উকিল বন্ধুর সঙ্গে কথা বলে। কিন্তু হঠাৎ করে যেই শাকিলা মতামত পরিবর্তন করে তখন তার বাবা রেগে যায়। ”

” আপনি একজন মা, নিজের মেয়ের সংসার রক্ষা করার জন্য কখনো স্বামীকে বুঝিয়েছেন? ”

” আমি আমার স্বামীর কথার উপর কোনদিন কথা বলতে পারতাম না। কারণ তিনি কখনো কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিতেন না, আমার মনে হচ্ছিল তিনি শাকিলার বিষয় সঠিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। ”

” হাদিস অনুযায়ী একটা পুরুষের চরিত্র সম্পর্কে তার স্ত্রী সবচেয়ে বেশি জানেন। আপনি আপনার স্বামীকে ঠিক কতটুকু ভালো মনে করতেন, তিনি যা করতেন সবকিছুই কি ঠিক? ”

” দেখুন, পৃথিবীতে সকল মানুষের ভুলত্রুটি আছে বা থাকবে, তবে ব্যক্তিগত হিসেবে আমার স্বামী খুব ভালো মানুষ ছিলেন। ”

” তাহলে আপনি শাকিলার পা ধরে কেন একদিন বলেছিলেন ‘ তোর বাবার কথা শোন নাহলে তো আমাদের সংসারে অশান্তি আসবে। ‘ এই কথা বলে কেন তার সাজ্জাদের সঙ্গে তাকে খারাপ ব্যবহার করতে বাধ্য করেছেন? ”

” দেখুন এটা পুরোপুরি সত্যি নয়, তাছাড়া মাঝে শাকিলা নিজেই সাজ্জাদকে সহ্য করতে পারতো না। সে বিবাহিতা অবস্থায়…”

এতটুকু বলতেই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সুমনা বলে উঠলো ” আহ মা, কিসব বলছো? ”

সাজু বললো ” দেখুন আমার কাছে কিছু গোপন করতে গেলে আপনারা বিপদে পড়বেন। কারণ আমি সত্যিটা খুঁজে বের করবোই, কিন্তু আপনারা যদি কিছু গোপন করেন তারপর সেটা আমাকে খুঁজে বের করতে হয়। তাহলে তখন সম্পুর্ণ সন্দেহ আপনাদের উপর এসে পড়বে, তাই একটা কথা গোপন করতে গিয়ে অনেকটা মিথ্যা বলা থেকে বিরত থাকুন। ”

সুমনা বললো ” আমরা কিছু লুকাইনি। ”

” শাকিলা তার স্বামীর সঙ্গে রাগ শেষে যতদিন এই বাড়িতে ছিল তখন কোন রুমে থাকতো। ”

” সুমনা বললো, আমার রুমে। ”

” আমি সেই রুমের মধ্যে একটু যেতে চাই। ”

” দেখুন রুমটা আমার, একটা মেয়ের রুমের মধ্যে হুট করে বাহিরের মানুষ প্রবেশ করতে পারে না। ”

” কিন্তু তবুও যেতে হবে। ”

” আচ্ছা চলুন। ”

সাজ্জাদকে আইসিইউ থেকে বের করে কেবিনে নেওয়া হয়েছে। যদিও মোটামুটি সুস্থ কিন্তু এখনো পরিষ্কার করে কথা বলে কিছু বলার শক্তি তার মধ্যে নেই। সাজুর পরামর্শে পুলিশ পাহারা আরও বৃদ্ধি করা হয়েছে, ওসি সাহেব নিজে সকাল বেলা ও বিকাল বা সন্ধ্যায় আসেন। সাজু ও রামিশা দুজন মিলে ওসি সাহেবের সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে এসেছে।

সাজ্জাদকে কিছু জিজ্ঞেস করার অনুমতি ডাক্তার দিলেন না, আরও একটা দিন অপেক্ষা করতে হবে তার সঙ্গে কথা বলতে হলে। কেবিন থেকে বেরিয়ে সাজু বললো,

” সাজ্জাদের বাসার প্রতিটি জিনিসে কার কার হাতের ছাপ আছে, বা কতজনের আছে, এগুলোর রিপোর্ট এসেছে? ”

” হ্যাঁ, যে লোহার রড দিয়ে সাজ্জাদকে আঘাত করা হয়েছে তাতে স্পষ্ট সাজ্জাদের নিজের হাতের ছাপ আছে। ঘরের বিভিন্ন আসবাবপত্র মোটামুটি অনেক কিছু টেস্ট করা হয়েছে কিন্তু সেখানে তেমন কিছু মেলেনি। ”

” আপনি কি জানেন, ওদের বাসায় একটা চেকবই ছিল সেখানে ২০ লাখ টাকা সিগনেচার করা। সাজ্জাদ নিজে শাকিলার জন্য রেখেছিল কিন্তু শাকিলা সেটা রেখেই নোয়াখালী গিয়েছিল। ”

” আমরা তো কোন চেকবই পাইনি, কিন্তু আপনি জানলেন কীভাবে? ”

” শাকিলা বলেছে, তবে সেই চেকবইয়ের কথা সাজ্জাদ সজীব ও শাকিলা ছাড়া আর কেউ মনে হয় জানে না। ”

” তাহলে সেটা কোথায়? ”

” সেটা খুঁজে বের করার দায়িত্ব আপনার, আপনি সাজ্জাদের ব্যাঙ্ক একাউন্টে খোঁজ লাগান। খোঁজ নিয়ে জানুন টাকা কি কেউ তুলে নিয়ে গেছে বা টাকা তুলতে কেউ গিয়েছে? ”

” আপনি এখন কোথায় যাবেন? ”

” সানোয়ার হোসেন, শাকিলার বন্ধুর কাছে। আর সেখান থেকে আপনার থানায় যেতে হবে কারণ শাকিলার কাছে কিছু প্রশ্ন করতে হবে। ”

” তাহলে থানাতেই দেখা হবে। ”

” আপনাকে তিনটা কাজ করতে হবে স্যার। ”

” বলুন। ”

” সজীব সাহেবকে চেকবই এর বিষয় ভালো করে জিজ্ঞেস করবেন। আপনার কাছে তিনটা নাম্বার দিচ্ছি সেই তিনটা নাম্বারের গত এক মাসের সকল কল লিস্ট যোগাড় করবেন। ”

” আর? ”

” আপাতত এগুলো। ”

” আমরা মোটামুটি নিশ্চিত সাজ্জাদ খুন করেছে, কেন শুধু শুধু জটিলতা তৈরি করেন? ”

” আচ্ছা আমিই সংগ্রহ করতে পারবো। ”

” দরকার নেই, আমি আপনার সবকিছু বের করে জানাবো, কিন্তু আমি বোঝাতে চাই এই বিষয়টা কেমন জটিল করছেন। ”

” স্কুলে আমার এক শিক্ষক ছিল, তিনি অংকের সময় সকল অংক জটিল সূত্রে সমাধান করতেন। একটা কঠিন সূত্র প্রয়োগ করে তাড়াতাড়ি করে সমাধান হয়ে যেত। তিনি বলতেন, একটু কষ্ট করে সূত্র মুখস্থ করলে পরীক্ষার হলে অনেক সময় সঞ্চয় করা যায়! ”

” ঠিক বলেছেন, মানুষ যত বেশি কষ্ট করবে ততই তাড়াতাড়ি সফল হবে। ”

” আমি তিনদিনের মধ্যে চেষ্টা করবো সমাধান করতে, কারণ আমার এক বন্ধু থাকে চট্টগ্রামে আর সে খুবই অসুস্থ। ”

” তার নাম কি? ”

” শফিক সজীব রকি ও সাজু আমরা চার বন্ধু, যে অসুস্থ তার নাম সজীব। ”

পড়ন্ত বিকেল, রাস্তার পাশে খোলা স্থানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে সানোয়ার। সানোয়ার হোসেন ছেলেটাকে যতটা চঞ্চল ভেবেছিল ততটা চঞ্চল মনে হচ্ছে না।

” জ্বি বলেন কে আপনি? ”

” শাকিলার বাবার খুনের রহস্য বের করার জন্য আমি চেষ্টা করছি। আপনি শাকিলার বন্ধু এবং তাকে একসময় অনেক পছন্দ করতেন তাই সেই কারণে আপনার কাছে আসা৷ ”

” আচ্ছা ঠিক আছে, কিন্তু আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি আপনাকে? ”

” তেমন কিছু না, শাকিলার বাবার কিছু গোপন কারবার বের করতে হবে। শাকিলা নিজেই স্বীকার করেছে তার বাবা অনেক অন্যায় কাজ করতেন, সেগুলোর দু একটা বের করতে হবে। ”

” কিন্তু আমি কীভাবে জানবো? ”

” যেহেতু শাকিলা তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড সেহেতু তার বাসায় নিশ্চয়ই যাতায়াত ছিল। অথবা ভুল করে হলেও একদিন না একদিন শাকিলা তার বাবার ছোটখাটো কোনো অপরাধ হলেও বলেছে। ”

” কিন্তু? ”

” আমি সেসব জানতে চাই না, আপনি শুধু তার সেই কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু ব্যক্তি খুঁজে বের করবেন। ব্যাপার টা যতটা কঠিন মনে হচ্ছে ততটা কঠিন নয়, ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলেই দেখবেন আপনি অনেক কিছু বের করতে পারবেন। ”

” আমাকে এসবের মধ্যে কেন জড়াচ্ছেন? ”

” আপনি নিশ্চয়ই চান শাকিলার বাবার খুনের আসল খুনি ধরা পড়ুক। ”

” হ্যাঁ অবশ্যই চাই। ”

” আমি পুলিশের সঙ্গে সবকিছু বলতে পারি না, কারণ তারা ছোটখাটো কিছু পেলেই সেটাকে হাত-পা বানিয়ে মিডিয়ার কাছে বলে দেয়। তখন তদন্তের অনেক গোপনীয়তা বের হয়ে যায়, আর এজন্যই কিন্তু পুলিশের চেয়ে গোয়েন্দারা রহস্য তাড়াতাড়ি বের করতে পারে। ”

” আমি চেষ্টা করবো আপনাকে সাহায্য করতে। ”

” আপনি তো শাকিলার সঙ্গে জেলের মধ্যে দেখা করতে যান মনে হয়, তাই না? ”

” হ্যাঁ দুবার গেছিলাম, ওর স্বামীর জন্য কান্না করে আবার নিজে বন্দী সেটাও আফসোস করে। ”

” দরকার হলে তার কাছে জিজ্ঞেস করে হলেও কিছু বের করবেন। ”

” জ্বি ভাই। ”

” মেলা মেলা ধন্যবাদ সানোয়ার হোসেন। ”

রিক্সায় পাশাপাশি বসে থানার দিকে যাচ্ছে সাজু ভাই ও রামিশা। ফুরফুরে বাতাস আর ব্যস্ততম শহরের মধ্যে মানুষের আনাগোনা। রামিশার ধারণা ছিল সাজু এখন গভীর চিন্তায় মগ্ন থাকবে কিন্তু তা না করে সে গুনগুন করে গান গাইছে।

” সাজু বললো, রামিশা তুমি কি কালকে সকালে উঠে নোয়াখালী যেতে পারবে আমার সঙ্গে? ”

” কিন্তু কেন সাজু ভাই ? ”

” সাজ্জাদ যে বাড়িতে গেছিলো সেই বাড়িতে ফেরদৌস গেছে কিনা সেটা জানার জন্য। ”

” মানে? ”

” ফেরদৌস সেদিন হয়তো ইচ্ছে করেই সাজ্জাদের সফর সঙ্গী হয়েছে। ”

” কিন্তু কেন? ”

” গোলমালটা সেখানেই, কার সঙ্গে কার যোগসূত্র সেটা নাম্বারের যাবতীয় কল লিস্ট পাওয়া পর্যন্ত বুঝতে পারছি না। ”

” কার কার নাম্বার ছিল সেখানে? ”

” শাকিলা, ফেরদৌস ও সাজ্জাদের বন্ধু সজীব। ”

” বলেন কি? এদের তিনজনের লিস্ট কেন? ”

” আগে রিক্সা থেকে নামো। ”

থানার মধ্যে ওসি সাহেব নেই, তিনি মাগরিবের কিছুক্ষণ আগে বের হয়েছেন। তবে সাজু আসলে যেন তার জন্য অপেক্ষা করে সেটা দারোগার কাছে বলে গেছে। দারোগা সাহেবের অনুমতি নিয়ে সাজু ভাই শাকিলার কাছে গেল।

শাকিলা বিমর্ষ মনে বসে আছে, সাজুকে দেখে মুখ তুলে তাকিয়ে রইল। চেহারা দেখে অবাক হয়ে গেল রামিশা, পিতার মৃত্যু আর স্বামীর অসুস্থতার টেনশনে কেমন হয়ে গেছে সে।

সাজু বললো ” কেমন আছেন আপনি? ”

” এইতো, আপনার কি অবস্থা? কোনকিছু খুঁজে বের করতে পেরেছেন? ”

” হ্যাঁ পেরেছি। ”

” তাহলে কি আমার বাবার খুনি তাড়াতাড়ি ধরা পড়বে? আমি আর আমার স্বামী মুক্তি পাবো? ”

” সবকিছু ঠিক হলে ঠিকই মুক্তি পাবেন। ”

” অনেক ধন্যবাদ। ”

” একটা কথা বলবো? ”

” বলেন। ”

” আপনি আমার সঙ্গে অনেক কিছু মিথ্যা বলেছেন আবার অনেক কিছু গোপন করেছেন। এর কারণ কি? ”

” কি মিথ্যা বলেছি? আর গোপন করবো কেন? ”

” সজীব সাহেবকে নিয়ে আপনার আর সাজ্জাদ এর মধ্যে কোনো ঝামেলা ছিল? সত্যি করে বলেন তো, সেদিন রাতে আপনাদের বাসায় সাজ্জাদ সজীব সাহেব আর আপনার বাবা ছিল তাই না? আপনি আমার কাছে এসব লুকিয়ে ঘটনা ঘুরিয়ে দিতে চাইছেন তাই না? এজন্যই সাজ্জাদ তার চিঠির শেষে লিখেছিল, ‘ তুমি কেন এমনটা করলে সেটা জানতে পারি নাই। ”

কুয়াশার মতো পর্বঃ- ০৬

” শাকিলা মেডাম আপনি রাগ করবেন না, আমি মাঝে মাঝে অদ্ভুত কিছু প্রশ্ন করে অবাক করার চেষ্টা করি। আমি ভাবছি অন্য কিছু। ”

” এভাবে সম্পুর্ন দোষারোপ করে কথা বলা ঠিক না সাজু ভাই, সবসময় ফাজলামো করা ঠিক না। ”

” হুম জানি, কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সিরিয়াস মুহূর্তে ফাজলামো করার ক্ষমতা সবার থাকে না। ”

” বলেন আপনার ভাবনা কি? ”

” সাজ্জাদ সাহেবের সেবার করার জন্য এই মুহূর্তে আপনাকে খুব বেশি দরকার। সে আপনাকে যায় কাছে পেত তাহলে মানসিকভাবে সে অনেকটা সুস্থ হয়ে যেত। ”

” কিন্তু আমি কি করবো বলেন? সেদিন রাগের মাথায় মাকে কিছু কথা বলেছি, মা সেই কথার জন্য আমার নামেও মামলা করবে ভাবিনি! ”

” পৃথিবীতে আমরা অনেক কিছু ভাবি না কিন্তু সেটা প্রকৃতি আমাদের সঙ্গে করে। আবার অনেক কিছু কল্পনাও করিনা, কিন্তু সেটাই জীবনে হাজির হয়ে যায়। ”

” আমি চেষ্টা করবো আপনাকে জামিনে মুক্তি করা যায় কিনা, যেহেতু আপনি খুনের সময় নোয়াখালী ছিলেন। তাছাড়া সন্দেহের তালিকায় সবার উপরে সাজ্জাদ। ”

” ও কথা বলবেন না, আমি জানি সাজ্জাদ আমার বাবাকে খুন করেনি। সাজ্জাদ খুন করতে পারে না সাজু ভাই, কারণ বাবা যদিও চাকরির মধ্যে কিছু দুর্নীতি করতেন। কিন্তু সাজ্জাদ কখনো বাবাকে অসম্মান করে গালি দিয়ে কথা বলে নাই। সামনে বা পিছনে কখনো বলে নাই, বরং সবসময় বলতো আল্লাহ তাকে জ্ঞান দিক। ”

” দেখুন রহস্যের সমাধান নিয়ে আমি এগিয়ে যাচ্ছি, সাজ্জাদ সাহেব সুস্থ হলে তার বক্তব্য থেকে অনেককিছু পাওয়া যেত। সেদিন রাতে সে কখন বাসায় গেছে, কীভাবে গেছে, কীভাবে আহত হয়ে গেছে? ”

” সাজ্জাদ কি কথা বলতে পারে? ”

” না, তবে বিপদমুক্ত। ”

” এ পর্যন্ত কোন আলামত পাওয়া গেছে যেগুলো দিয়ে সামনে বাড়াবেন! ”

” হ্যাঁ পেয়েছি, ৬০% বের হয়ে গেছে, আজকে কিছু নাম্বারের কল লিস্ট আসবে। তারপর সেখান থেকে আরও ২০% পাওয়া যাবে, তারপর বাকিটা আমি বের করে নেবো। ”

” কাকে কাকে সন্দেহ হয়? ”

” সজীব সাহেব, ফেরদৌস, উকিল সাহেব, বাড়ির মালিক, ইত্যাদি! ”

” ফেরদৌস তো আমার সঙ্গে ছিল, আর সজীব ভাই আমাদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ব্যক্তি। ”

” এটা আমার সন্দেহের তালিকা, পরীক্ষার সময় অনেক ক্ষেত্রে সাজেশনে ৮০% এর প্রশ্নটাও কমন পরে যায়। ”

” কিন্তু সজীব ভাই সকাল বেলা আমাকে যখন বললেন আপনারা তাকে সন্দেহ করছেন তখন আমার লজ্জা লেগেছে। ”

” হাহাহা, লজ্জা কেন? আমরা কিছু তথ্যের জন্য তাকে সন্দেহ করতেই পারি। এতে করে আপনার বা তার লজ্জিত হবার কারণ কি? ”

” আপনি সজীব ভাইকে সন্দেহের তালিকা থেকে বের করে রাখুন, তিনি আমার বাবাকে খুন করে নাই আমি জানি। ”

” আপনার স্বামীর বন্ধুর প্রতি আপনার বিশ্বাস মুগ্ধ করেছে আমাকে, তবুও আমি আমার সন্দেহের তালিকা আমার কাছে রাখি। ”

” আমার মা-বোন কেমন আছে? তারা কেউ যখন খোঁজ নেয় না তখন খুব খারাপ লাগে। ”

” আশা করি খুব দ্রুত আপনার জীবন থেকে সব বিপদ কেটে যাবে, ধৈর্য ধরুন। ”

★★

রাত আনুমানিক সাড়ে দশটা।
ডিনার করে বাসার ছাদে হাঁটছে সাজু, মাথার মধ্যে কয়েকটা মানুষের মুখ ভাসছে। সবকিছু কেমন যেন কুয়াশার মতো মনে হচ্ছে, দুর থেকে অন্ধকার কিন্তু সামনে এগিয়ে গেলে কিছুটা হলেও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। কুয়াশার মধ্যে যেমন অনেক দুরের পথ দেখা যায় না, এই রহস্যের অবস্থা ঠিক তাই। এখনই বোঝা যাচ্ছে না অনেক সামনে কি আছে, চোখের সামনে যা ঘটছে তাই দেখে পথ চলতে হচ্ছে সামনে।

সাজুর ধারণা, খুব শীঘ্রই কুয়াশা কাটতে শুরু করবে। হুট করে সূর্যের আলোতে উজ্জ্বল হয়ে যাবে সবকিছু, ধরা পড়বে আসল খুনি।

সজীবের প্রতি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সন্দেহ হচ্ছে, তার সঙ্গে সাজ্জাদের খুব বেশি ভালো সম্পর্ক ছিল ঠিকই। কিন্তু সজীব মাঝে মাঝে খুব অন্যায় জনিত কাজ করতো, যেগুলো সাজ্জাদ মেনে নিতো কিন্তু খুশি হতো না।

মোবাইল বেজে উঠল, স্ক্রিনে অপরিচিত নাম্বার দেখে তাকিয়ে রইল সাজু। একদম শেষ মুহূর্তে রিসিভ করে শান্ত গলায় বলল,

” আসসালামু আলাইকুম। ”

অপরদিক থেকে মেয়েলি কণ্ঠে বললো, ” ওয়া আলাইকুম আসসালাম, সাজু ভাই আমি সুমনা। শাকিলা আমার বড় আপু, আপনার সঙ্গে আজ আমাদের কথা হয়েছে। ”

” ওহ্ আচ্ছা তুমি? বলো তাহলে, আচ্ছা তুমি আমার নাম্বার পেলে কোথায়? ”

” কি যে বলেন সাজু ভাই, আপনি অনলাইন জগৎ এর মধ্যে মোটামুটি পরিচিত। সাজু ভাই হিসেবে আপনাকে অনেকেই চেনে, আপনি ব্যক্তিগত ভাবে গোয়েন্দা হলেও আপনার লেখালেখি আপনাকে বেশি পরিচিত করেছে। ”

” হাহাহা, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তুমি নাম্বারটা অন্য উপায়ে সংগ্রহ করেছো। ”

” আমি এইমাত্র আপুর সঙ্গে দেখা করে বাসায় এসেছি, আপুর কাছে আপনার নাম্বার নেই। কিন্তু আপু আপনার লেখালেখির সম্পর্কে বললেন, তাই বাসায় এসে ফেসবুকে সার্চ করলাম। ”

” তারপর? ”

” তারপর তো দেখলাম আপনার অনেক পরিচিতি ও সুনাম, তারপর পেইজ থেকে নাম্বার নিলাম। তবে আমি চাইলেই ফেরদৌস নামের ছেলেটার কাছ থেকে নিতে পারতাম। কারণ আপু বলেছিল আপনাকে নাকি ফেরদৌস নিয়ে এসেছে, তাই তার কাছে অবশ্যই নাম্বার আছে। ”

” হুম বুঝলাম, তাহলে নিলে না কেন? ”

” সাজু ভাই, সত্যি বলতে ফেরদৌস ছেলেটার প্রতি আমার কেমন সন্দেহ হচ্ছে। লোকটার খুব অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি, আপুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার পর থেকে তার যাবতীয় কর্মকাণ্ড ফেলে রেখে আপুর পিছনে পড়ে আছে। ”

” হ্যাঁ বিষয়টা আমাকেও ভাবাচ্ছে। ”

” সে আপুর সঙ্গে যা যা করতো সবকিছুই আমার কাছে কল দিয়ে বলতো। বাবার খুনের পরও সে বারবার কল করতো, কেমন অদ্ভুত লাগে। আবার নিজেই বেশি ভালো হবার জন্য আপনাকে ডেকে নিয়ে এসেছে। যদি সে অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকে তাহলে যেন কোনভাবেই তাকে সন্দেহ করা না হয়। ”

” হুম তোমার ধারণা ঠিক। আমি ভাবছিলাম তার গ্রামের বাড়িতে যাবো, সেখানে গিয়ে খোঁজ নিয়ে কিছু কথা জানা দরকার। ফেরদৌসের বোনের মৃত্যুর সঙ্গে কোনভাবে সাজ্জাদ কিংবা তোমার বাবার কোন হাত আছে কিনা কে জানে। ”

” দুলাভাই হবে না সাজু ভাই, কিন্তু বাবার হতেও পারে কারণ তার সঙ্গে শহরের খারাপ কিছু মানুষ যোগাযোগ করতো। ফেরদৌসের কথা অনুযায়ী তার বোনের স্বামী ছিল নেশা করতো, এখন সেই কারণে কোনো যোগাযোগ নিশ্চয়ই হতে পারে। ”

” মেলা মেলা ধন্যবাদ সুমনা। ”

” মায়ের সামনে সাজ্জাদ ভাইকে ছাড়া আর কাউকে বাবার খুনি বলতে পারি না। মায়ের সম্পুর্ন ধারণা যে বাবাকে খুন করেছে সাজ্জাদ ভাই, কিন্তু আমার ধারণা আসল খুনি দিব্যি ভালো আছে। ”

” তুমি চিন্তা করো না, আমি যেভাবেই হোক এই রহস্যের সমাধান করবো। তোমার মাকে শান্তনা দেবার দায়িত্ব তোমার, মাঝে মাঝে হাসপাতালে গিয়ে গোপনে সাজ্জাদকে দেখে এসো৷ থানায় গিয়ে বোনে সঙ্গে দেখা করবে, এই মুহূর্তে সম্পুর্ন পরিবারের সবাইকে আলাদা করে শান্তি দিতে পারবে তুমি। ”

” সাজু ভাই। ”

” ঠিকই বলছি সুমনা, এমন সুযোগ সবার আসে না কিন্তু, সাজ্জাদ হাসপাতালে, শাকিলা থানায়, তোমার মা অসুস্থ হয়ে বাসায়। প্রতিটি মানুষের দরকার সান্তনা এবং সঙ্গী, তোমাকে সেই দায়িত্ব পালন করতে হবে। ”

” দোয়া করবেন, আে আমার বাবা যতই খারাপ থাকুক কিন্তু আমি চাই তার খুনি শাস্তি পাক। ”

” অবশ্যই পাবে। ”

” একটা প্রশ্ন করবো সাজু ভাই? ”

” হ্যাঁ করো। ”

” রুহি কে? ”

” কেন? আর তুমি তার কথা কীভাবে জানো? ”

” আপনার কাছে কল করার আগে আমার একটা বান্ধবী কল করেছিল। সে জিজ্ঞেস করেছিল যে আমার বাবার খুনের মামলা কে দেখছেন। যখন বললাম সাজু ভাই, সে প্রচুর অবাক হয়ে গেল। ”

” কেন? ”

” আপনার পরিচিত পাঠিকা, সে আপনার সঙ্গে দেখা করতো কিন্তু এখন দেশের বাইরে। ”

” ওহ্ আচ্ছা। ”

” আপনার কাছে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে বলে দিয়েছে। ”

” কি কথা? ”

” সে বললো, সাজু ভাইকে জিজ্ঞেস করে বলবে তার বন্ধু সজীবের কি খবর? আর রুহি কেমন আছে? ”

” আচ্ছা আরেকদিন বলবো তোমাকে। ”

” আসল কথা বলা হয়নি এখনো। ”

” কি কথা? ”

” বাবার উকিল বন্ধু আমাদের বাসায় এসেছিল, তিনি হঠাৎ মাকে অনেক বোঝাতে লাগলো। মা যেন আপুর বিরুদ্ধে মামলা তুলে নেয়, মা প্রথমে রাজি ছিল না। কিন্তু শেষ সময়ে মা রাজি হয়েছে, কালকে সকালে থানায় গিয়ে আপুর মামলা তুলে নেবে মা। ”

” তাহলে খুবই ভালো হবে, সাজ্জাদের পাশে এই মুহূর্তে শাকিলার খুব দরকার। ”

” আজ তাহলে রাখি সাজু ভাই, আপনি একটু ফেরদৌসের বিষয় ভালো করে খোঁজ করুন। ”

” হ্যাঁ করবো। ”

★★

পরদিন বেলা এগারোটা।
রেস্টুরেন্টে বসে বসে রুটি দিয়ে গ্রিল খাচ্ছে সাজু ভাই ও রামিশা। রামিশা আজ শাড়ি পরেছে, হুট করে এমন পরিবর্তন কেন সেটা সাজু বুঝতে পারছে না। তাই নিয়ে কথা হচ্ছিল, এমন সময় ওসি সাহেবের কল এসেছে।

” হ্যালো স্যার। ”

” সাজু সাহেব আপনি কোথায়? ”

” আমি রেস্টুরেন্টে, কিন্তু কেন? ”

” তাড়াতাড়ি হাসপাতালে আসতে পারবেন? কেউ একজন সাজ্জাদকে কিছু একটা খাইয়ে দিয়েছে, শরীর দ্রুত অবনতি হচ্ছে। ”

” বলেন কি? ভিতরে কে প্রবেশ করেছে? ”

” ডাক্তার নার্স ছাড়া, আজকে সাজ্জাদের স্ত্রী শাকিলা এসেছে ঘন্টা খানিক আগে। ”

” শাকিলা বের হয়েছে? ”

” হ্যাঁ সকাল বেলা তার মা তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছে, কিন্তু সে হাসপাতালে আসতেই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ”

” তারমানে কি শাকিলার মধ্যে গন্ডগোল নাকি? সে কি চায় না সাজ্জাদ বাঁচুক, সাজ্জাদ বাঁচলে সেই রাতের গোপন কিছু বের হবে নাকি? ”

” আপনি একটু হাসপাতালে আসুন। ”

কুয়াশার মতো পর্বঃ- ০৭

হাসপাতালে সবার সামনে শাকিলা কেঁদে কেঁদে বললো ” আমি সাজ্জাদকে খুব ভালোবাসি, তাকে কেন মারতে চাইবো বলেন? ”

” ওসি সাহেব বললেন, নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে কিংবা সাক্ষী হিসেবে যেন বেঁচে না থাকে সেজন্য। ”

শাকিলার কান্না বাড়তে লাগলো, কান্নার জন্য সে কথা বলতে পারছে না। চারিদিকে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে গেছে, সাজু ভাই রামিশা ওসি সাহেব সুমনা ফেরদৌস আরও অনেকে৷ কিছু অপরিচিত মুখ আছে এরা হয়তো আশেপাশের কোন রোগীর স্বজন হতে পারে।

অসহায়ের মতো কান্না করতে করতে সাজুর দিকে চোখ পড়তেই দু’পা এগিয়ে গিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসে সাজুর ডান হাতটা ধরে কেঁদে কেঁদে,

” সাজু ভাই আপনি অন্তত বিশ্বাস করুন আমার স্বামী সাজ্জাদকে আমি অনেক ভালোবাসি। ওর কোনো ক্ষতি হোক সেটা স্বপ্নেও ভাবিনি, মা-বাবা চাইতো না বিধায় মনের বিরুদ্ধে গিয়ে আমি ওকে কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন সাজু ভাই, ওকে যতটা কষ্ট দিয়েছি তারচেয়ে বেশী কষ্ট আমি ভোগ করেছি, হ্যাঁ আমি। ”

” সাজু বললো, কিন্তু আপনার খাবার খেয়ে তো সাজ্জাদ অসুস্থ হয়ে গেছে। ভাগ্যিস এক চুমুক জুস খাবার সঙ্গে সঙ্গে নার্স নিষেধ করেছে। কারণ সাজ্জাদের এসব খাওয়া ঠিক না, নাহলে তো পুরোটা খাইয়ে দিতেন। ”

শাকিলা পূর্বের ন্যায় আরও অসহায় বোধ করতে লাগলো নিজেকে। সে সাজুর হাতটা চেপে ধরে শুধু বললো,

” আমি সত্যিই জানি না জুসের মধ্যে এসব কোই থেকে এসেছে? যদি জানতাম তাহলে নিজে খেয়ে মরে যেতাম তবুও ওকে দিতাম না। ”

” ওসি সাহেব বললো, আপনার স্বামীর বন্ধুর মতো আপনাকেও হাসপাতাল থেকে বের করে দিচ্ছি। ”

” আমি আমার সাজ্জাদকে রেখে কোথাও যাবো না, মেরে ফেললেও না। আপনারা আমার কথা একটু বিশ্বাস করুন স্যার, আমি কিছু করিনি। ”

এবার সাজু কিছুক্ষণ ভাবলো, তারপর হাত দিয়ে শাকিলাকে দাঁড় করিয়ে বললো,

” থানায় তোমাকে আনতে কে কে গেছিল? ”

” মা সুমনা আর ফেরদৌস। মামলা তুলে নিয়ে মা সেখান থেকে বাসায় চলে গেছে, আর আমরা তিনজনে চলে এসেছি হাসপাতালে। ”

” খাবার গুলো কখন কিনেছেন? ”

” সিএনজি করে আসার সময় আমি হঠাৎ করে ফেরদৌস বললো কিছু কিনে নিয়ে যাই। তারপর রাস্তার পাশে সিএনজি থামিয়ে আমি আর সুমনা বসে ছিলাম আর ফেরদৌস কিনে এনেছে। ”

” ওহ্ আচ্ছা বুঝতে পেরেছি, তারমানে কেনার সময় ফেরদৌস সাহেব ওই বিষাক্ত ওষুধটা মিশিয়ে দিয়েছে। ”

” কিন্তু বোতল নতুন ছিল, আমি নিজের হাতে সেটা খুলেছি। ”

” যদি পূর্ব পরিকল্পিত হয়ে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই ইঞ্জেকশন করার সিরিঞ্জের মধ্যে আগেই বিষাক্ত ওষুধ ছিল। সেটাই বোতলে পুশ করছে। ”

এবার উৎসুক জনতা ফেরদৌসের দিকে তাকিয়ে রইল, ফেরদৌস যেন আকাশ থেকে পরে একদম স্থির হয়ে গেল। নিজের চোখ আর কানকে বিশ্বাস করাতে পারছে না যে ‘ সাজু ভাই তাকে সন্দেহ করে বিষাক্ত ওষুধ মেশানোর কাহিনি গড়গড় করে বলে দিচ্ছে। ‘

” ফেরদৌস বললো, এসব কি বলছেন আপনি? আমি কেন করতে যাবো? আমি তো চাই তাদের সবার ভালো হোক, নিজের দৈনিক ব্যস্ততা রেখে আমি আপুর সঙ্গে আছি। নিজের বোনের মতো সম্মান করি বলে এতকিছু করলাম আর সেখানে আমাকেই ফাঁসিয়ে দেওয়া হচ্ছে? ”

” ওসি সাহেব বললেন, তোমাকে ফাঁসানো হচ্ছে না বরং তুমি নিজে ফেঁসে যাবার কাজ করছো। তাই যা যা করেছো সত্যি সত্যি বলো, থানায় গিয়ে যদি রিমান্ডের দরকার হয় তাহলে তো…! ”

ফেরদৌস শাকিলার দিকে তাকিয়ে করুণ কণ্ঠে বললো ” আপু আমাকে কেন দোষারোপ করছেন বলেন, আমি কি এমন করেছি? ”

” সাজু বললো, একটা অপরিচিত মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হবার সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতি অতিরিক্ত এই আপ্যায়ন আমাদের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি করেছে ফেরদৌস ভাই। ”

” সাজু ভাই আপনাকে কিন্তু আমি নিজেই এনেছি এই মামলার রহস্য সমাধান করতে। যদি আমার কোন অপরাধ থাকতো তাহলে আমি আপনাকে কেন আনবো? আমি তো জানি আপনি এলে খুনি বের হবেই হবে, আপনি বুদ্ধিমান। ”

” ওই যে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি, তুমি বেশি ভালো হতে গিয়ে সমস্যা পাকিয়ে গেছে। লেবু কচলালে তেতো হয়ে যায়, সবকিছুই পরিমাণ মতো করতে হয় নাহলে বিপদ। ”

” আমি এখন বুঝতে পারছি সেটা, যদি জানতাম এভাবে ফেঁসে যাবো তাহলে কিছুতেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতাম না। আর আপনাকে ডাকার কোন প্রশ্নই আসতো না সাজু ভাই। ”

এমন সময় ডাক্তার এসে বললো ” সাজ্জাদ এখন মোটামুটি বিপদ মুক্ত, সে নাকি তার স্ত্রী শাকিলার সঙ্গে কথা বলতে চায়। সবাই শাকিলাকে সন্দেহ করেছে শুনে সে মন খারাপ করেছে। ”

সুতরাং আপাতত আলোচনা এখানেই স্থগিত করা হয়েছে, সবাই দাঁড়িয়ে আছে। সাজু ভাই রামিশা ওসি সাহেব ও শাকিলা সবাই সাজ্জাদের কেবিনে প্রবেশ করলো।

শাকিলা কেবিনে প্রবেশ করেই আবার কান্না শুরু করে দিল, তারপর বেডের কাছে গিয়ে সাজ্জাদের মাথা বরাবর ফ্লোরে বসে সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে বললো,

” তুমি বিশ্বাস করো তোমাকে আমি মারতে চাই নাই, এরা সবাই আমাকে ভুল বুঝছে। ”

” সাজ্জাদ আস্তে আস্তে বললো, আমি জানি তুমি এমনটা করতে পারো না। ওসি সাহেব আপনি ওকে কিছু বলবেন না, আপনারা আসল খুনি বের করতে চেষ্টা করুন। ”

সাজু বললো ” আমি যদি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই তাহলে উত্তর দিতে পারবেন? ”

” জ্বি চেষ্টা করবো। ”

সাজু তখন নিজের মোবাইলের স্ক্রিন সাজ্জাদের দিকে তাক করে ধরলো।

বললো ” দেখুন তো এই প্রকৃতির পিকচারটা কেমন লাগে? ”

সাজ্জাদ তাকিয়ে দেখে মোবাইলের স্ক্রিনে কোন প্রকৃতির পিকচার নেই। সেখানে মাত্র কয়েকটি লাইন লেখা আছে ” ডায়েরি ” সফটওয়্যারে।

সাজ্জাদ বিড়বিড় করে পড়ছে সেখানে লেখা,

” সাজ্জাদ ভাই আপনাকে কিছু প্রশ্ন করবো তারপর আপনি হুট করে বলবেন আপনার বাসায় ড্রইং রুমে একটা লুকানো ছোট্ট ক্যামেরা আছে। সেদিন রাতে কি কি হয়েছে সেটা সেই ক্যামেরা পেলেই জানা যাবে। আমি জানি ক্যামেরা নেই কিন্তু তবুও আপনাকে এটা বলতে হবে কারণ সেই কথা পুলিশসহ সবাই জানতে পারবে। আর খুনির কানে পৌঁছে যেতে পারে। ”

সাজ্জাদ অবাক হয়ে গেল, সাজুর দিকে তাকিয়ে বললো ” বাহহ অনেক সুন্দর লাগছে। ”

” আপনার মানসিকতা সুন্দর করার জন্য ছবিটি দেখালাম এবার বলেন, সেদিন রাতে আপনার বাসায় ড্রইং রুমে কি হয়েছিল? ”

” আমি রাত আড়াইটার দিকে বাসায় গেলাম, দরজা খোলা দেখে অবাক হলাম। কারণ আমি জানতাম শাকিলা নোয়াখালী চলে গেছে আমার সন্ধান করতে। ”

” তারপর? ”

” আমি ভিতরে প্রবেশ করতেই কেউ একজন আমার মাথায় সজোরে আঘাত করে। কে ছিল সেটা বোঝার ক্ষমতা ছিল না, মুহূর্তের মধ্যে আমি ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ি। ”

” আপনি কি দেখেছিলেন যে আপনার শশুরের লাশ পরে আছে? ”

” না দেখতে পাইনি কারণ বাতি বন্ধ ছিল, আর আমি মোবাইল বের করতে করতে আঘাত এসে লেগেছিল। ”

” শাকিলা তার মায়ের কাছে কল দিয়ে বাবাকে খুন করার হুমকি দেয়, জানেন আপনি? ”

” জ্বি না। ”

” আপনার বাসায় আপনার শশুর খুন হয়েছে, এ বিষয়ে আপনার কি ধরনের ধারণা হচ্ছে? কারা বা কি কারণে এটা করতে পারে? যদি আপনার শশুর তাদের টার্গেট হতো তাহলে কিন্তু যেকোনো স্থানে অনায়সে মারতে পারতো। কিন্তু তা না করে তাকে আপনার বাসায় ড্রইং রুমে মারা হয়েছে। ”

” আমার বাসার ড্রইং রুমে একটা লুকানো ছোট্ট ক্যামেরা আছে, আমি সেটা শাকিলার জন্য সেট করেছিলাম। ”

” যেমন? ”

” আমি সেদিন অভিমান করে চলে আসার পর আমার বিশ্বাস ছিল শাকিলা আসবে। কিন্তু সে আসার পরে তার কতটা খারাপ লাগে সেটা নিজ চোখে দেখতে চেয়েছিলাম। ”

” তারমানে আমরা যদি সেই ক্যামেরা উদ্ধার করতে পারি তাহলে তো জানতে পারবো আসলে কি ঘটেছিল সেই রাতে। ”

” হ্যাঁ, যদি খুনিরা সেই ক্যামেরা নষ্ট না করে তবে অবশ্যই পাবেন। ”

সাজু মনে মনে বললো, বাহ কত সুন্দর করে সাজিয়ে কথা বলে দিল। যদিও এটা মিথ্যা তবুও যদি সামান্য মিথ্যা দিয়ে কিছু বের করা যায়।

এই সময়ে ওসি সাহেব একটা প্যাঁচ লাগিয়ে প্রশ্ন করে বসলো, ” আপনি যদি জানতেন বাসায় কি হচ্ছে তাহলে তো আগেই দেখার কথা। কারণ মনে হয় আপনি আপনার মোবাইলে কানেক্ট করে রেখেছেন তাই না? ”

ওসি সাহেবের এরূপ প্রশ্নের জবাবে সাজ্জাদ বললো,

” জ্বি, কিন্তু শাকিলা নোয়াখালী রওনা দেবার পরে আমি আর বাসার ক্যামেরা চেক করিনি। ”

ওসি সাহেব হয়তো আরও কিছু জিজ্ঞেস করতে চায়, সাজ্জাদ ভ্যাবাচেকা হয়ে সাজুর দিকে তাকিয়ে রইল। সাজু তখন ওসি সাহেবকে নিয়ে বের হবার তাড়া দিল, ওসি সাহেব বিমর্ষ মনে বের হয়ে গেল।

বাহিরে বেরিয়ে ওসি সাহেব ফেরদৌসকে সেখানে থাকতে বললেন। সাজুে উদ্দেশ্য ছিল ওসি সাহেব নিজে সবটা বলুক তারা কোথায় যাচ্ছে?

শাকিলা কেবিন থেকে বের হয়ে এসে বললো,
আমিও আপনাদের সঙ্গে যাবো৷

” কিন্তু কেন? ”

” আমিও সবটা দেখতে চাই সাজু ভাই, প্লিজ আমাকে নিয়ে চলুন। ”

ওসি সাহেব ও সাজু দুজনেই দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার সোজা হলেন। তারপর চারজন মিলে রওনা দিল বাসায়।

বাসায় ওঠার ঠিক আগ মুহূর্তে সাজু তার বন্ধু রামিশাকে বললো,

” তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। ”

” রামিশা বললো, কি কাজ? ”

” আমরা যখন ড্রইং রুমে ক্যামেরা খুঁজে বের করার ভান করবো তখন তুমি পাশের রুমে গিয়ে কিছু একটা ফেলে দেবে। তারপর আমরা দৌড়ে সেখানে যাবো, এবং সেই ১ মিনিটের মধ্যে আমি একটা ক্যামেরা সেট করে দেবো। ”

” তারমানে কি কোন ক্যামেরা নেই? ”

” না নেই, ওটা সাজ্জাদ মিথ্যা বলেছে, কারণ আমি তাকে বলতে বলেছি৷ ”

সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় সাজুে মোবাইল বেজে উঠল, সাজু মোবাইল বের করে দেখে শাকিলার বোন সুমনা কল করেছে। সাজু রিসিভ করে বলে,

” হ্যাঁ সুমনা বলো। ”

” সাজু ভাই আপনারা কোথায়? ”

” আমরা তোমার আপুর বাসায়, সাজ্জাদ নাকি ড্রইং রুমে একটা ক্যামেরা লুকিয়ে রেখেছিল অন্য কারনে। আজ হয়তো সেটা খুনি ধরার কাজে অনেক সাহায্য করবে। ”

” মানে? ”

” চমকে গেলে কেন সুমনা? ”

” কোই না তো, কেন চমকাবো? ”

” চমকানোর কারণ তো অবশ্যই আছে, বড়আপুর চাবির গোছা থেকে চাবি সরিয়ে রাখা। তারপর সেই চাবি অন্য কারো কাছে দেওয়া, এতগুলো টাকার সই করা চেকবই। ”

” কি বলছেন এসব? ”

” সাজ্জাদের জুসের বোতলে বিষাক্ত ওষুধ মেশানোর কাজটা খুনি খুব ভালো করে করেছে। মানতে হবে তার অনেক বুদ্ধি আছে, কারণ এমন নিখুঁত কাজ সহজে করা যায় না। ”

” সাজু ভাই…! আমি কিছু করিনি। ”

কুয়াশার মতো পর্বঃ- ০৮ (শেষ)

” শাকিলা আপুর কাছ থেকে চাবি নিয়েছি ঠিকই কিন্তু আমি বাবাকে খুন করিনি। ”

” সাজু বললো, আমি তো তোমাকে বলিনি, তুমি কেন শুধু শুধু এসব বলছো? ”

” তাহলে ওভাবে কথা বললেন কেন? আপনার নিশ্চয়ই আমাকে সন্দেহ হচ্ছে নাহলে কেন অমন করে প্রশ্ন করলেন? ”

” আমি তো সবাইকে সন্দেহ করি সুমনা, তোমার আপু দুলাভাই, সজীব সাহেব, ফেরদৌস এরা সবাই আমার সন্দেহের তালিকায় আছে। ”

” আমি আপনার সঙ্গে এখনই দেখা করতে চাই সাজু ভাই, সত্যি বলছি আমি কিছু করিনি। ”

” তাহলে তোমার বোনের বাসায় চলে আসো, আমরা সবাই সেখানেই আছি৷ ”

সাজুে মোবাইলের কথা শুনে শাকিলা ও ওসি সাহেব দুজনেই তাকিয়ে রইল। সাজু কিছু না বলে চুপচাপ উপরে উঠতে লাগলো, তার সঙ্গে সঙ্গে উঠে যাচ্ছে বাকিরা।

দরজা খুলে বাসায় প্রবেশ করলো সবাই। সাজু তখন চারিদিকে তাকিয়ে খুঁজতে লাগলো, রামিশা ঠিকই পাশের রুমে গিয়ে একটা গ্লাস ফেলে দিল। ওসি সাহেব ও শাকিলা সেদিকে গিয়েছে ঠিকই কিন্তু সাজু কোনো ক্যামেরা স্থাপন করে নাই।

ড্রইং রুম থেকে বেডরুমে গিয়ে চারিদিকে তাকিয়ে অস্বাভাবিক কিছু খোঁজার চেষ্টা। তেমন কিছু এলোমেলো চোখে পড়ে নাই, ওসি সাহেব মনে হয় বেশি আশাহত হয়ে গেছে। কারণ সমস্ত ফ্ল্যাট তন্নতন্ন করে কোথাও ক্যামেরা পাওয়া যায় নাই।

রামিশা নিজেও অবাক হলো কারণ তাকে যেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সে সেটা পালন করেছে। তাহলে সাজু ভাই কেন তার কাজটা করে নাই? নাকি নতুন কোনো পরিকল্পনা।

ওসি সাহেব একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন তখন সুমনার সঙ্গে কি নিয়ে কথা হয়েছে? সাজু বললো যে সুমনা আসলেই সবকিছু বলবে, আপনি একটা কাজ করেন ওসি সাহেব।

– কি কাজ?

– হাসপাতালে কল দিয়ে ফেরদৌসকে সঙ্গে নিয়ে একজন পুলিশকে আসতে বলেন। যেহেতু এখানে সবকিছু ঘটেছে সেহেতু এখানেই সকল সমাধান করে দেই।

সুমনা এসেছে, তার সমস্ত চোখেমুখে লেপ্টে আছে চিন্তার ছাপ। সোফায় বসে সাজু সুমনার দিকে তাকিয়ে বললো,

– এতো তাড়াতাড়ি চলে এলে?

– বাবার খুনী কে, জানা গেছে?

– না এখনো জানা যায় নাই তবে আজকেই জানা যাবে চিন্তা করো না।

– ক্যামেরা পাওয়া গেছে?

– না, আমি সানোয়ার হোসেন মানে শাকিলার বন্ধু কে এখানে আসতে বলেছি। তিনি এলেই আসল খুনি বের হয়ে যাবে৷

– শাকিলা যেন চমকে গেল, বললো ” সানোয়ার? সে এখানে কীভাবে আসবে? ”

– সাজু বললো, অবাক হবার কিছু নেই আপনার বাবার কিছু অবৈধ কাজের সঙ্গীদের লিস্ট তৈরি করে ফেলেছে সানোয়ার। তার সেই লিস্টের মধ্যে আসল খুনি আছে, সে আসুক ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

সবাই যেন থমথমে, একটু পরে দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো ফেরদৌস ও একজন পুলিশ। ফেরদৌস যেন আরও বেশি চিন্তিত হয়ে গেছে, একটু পরে সানোয়ার হোসেন প্রবেশ করলো।

সাজু ভাই সুমনার দিকে তাকিয়ে বললো,

– তুমি তোমার আপুর চাবির গোছা থেকে কখন চাবি চুরি করছ?

– আমি চুরি করিনি, চাবি নিয়েছিল বাবা। বাবা যখন দারোয়ানের কাছে চাবি দিতে গেল তখন সে একটা চাবি লুকিয়ে রাখে। তারপর বাকি দুটো দারোয়ানের কাছে দিয়ে আসে কিন্তু আমার চোখে ধরা পড়ে। আমি বাবার কাছে জিজ্ঞেস করলাম তখন বাবা আমাকে ধমক দিলেন। আর বললেন “এ কথা কেউ যেন না জানে, তিনি সাজ্জাদ ভাই কে উচিৎ শিক্ষা দিবেন। ”

– শাকিলা বললো, তাহলে তুই পরদিন সকালে আমাকে বলিসনি কেন?

– সুমনা কেঁদে কেঁদে বললো, আপু আমাকে মাফ করে দিও, তুমি এমনিতেই বাবার প্রতি অনেক রেগে আছো তখন। তাই নতুন কিছু বলে তোমার রাগ বাড়াতে চাইনি, ভেবেছিলাম তুমি তো ভাইয়ার কাছে যাচ্ছো তাহলে বাবা চাবি দিয়ে কি করবে?

– তবুও তোমার বলা উচিৎ ছিল, সাজু ভাই বললেন।

– হ্যাঁ আমি বলতে চেয়েছিলাম, আর সেজন্য আপুর সঙ্গে বলেছিলাম যে বাবার বিষয় কিছু কথা আমি বলবো তবে সেটা সরাসরি। কিন্তু তার আগেই তো সবকিছু এমন এলোমেলো হয়ে গেল।

– সাজু বললো, তোমার বাবা যখন এই বাসায় এসেছে তখন তুমি কি জানতে?

– হ্যাঁ জানতাম, বাবা কাকে যেন কল দিয়ে বলে যে ” তুমি তৈরী থাকো আমি আসতেছি, আজকে একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। ” আমি ভাবলাম আপু দুলাভাই দুজনেই তো নোয়াখালী তাই ফাঁকা বাসায় গিয়ে কি করবে তারা? কিন্তু তবুও মনটা খারাপ লাগে তাই আপুর কাছে কল দিলাম কিন্তু আপু রিসিভ করে নাই রাতে।

– ওসি সাহেব বললো ” তারপর তুমি যখন দেখলে তোমার বাবা বাসায় ফিরছে না তখন একাই বের হয়ে গেলে তাই না? ”

– না আমি বাইরে আসিনি, আমাদের বাসার দারোয়ান কাকাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন।
কিন্তু আমি যদি জানতে পারতাম বাবা এই রাতেই খুন হবে তাহলে ঠিকই বের হতাম।

সাজু ভাই তখন ফেরদৌসের দিকে তাকিয়ে রইল, ফেরদৌস কাচুমাচু হয়ে গেল। সাজু বললো,

– তোমার দুলাভাই খুব নেশা করতো তাই না?

– জ্বি।

– শাকিলার বাবা মাদক ব্যবসা করতেন টুকটাক, তার অফিসের চাকরি ছিল লোক দেখানো। আর তোমার দুলাভাই ছিল তার একজন রেগুলার কাস্টমার। অনেক টাকা বাকি পড়ার কারণে সেই টাকা পরিশোধ করতে না পারায় শাকিলার বাবা তোমার আপুর বাসায় গেছিল। ঠিক?

– জ্বি।

– বলো তো আমি কীভাবে জানলাম?

– জানি না সাজু ভাই, তবে হ্যাঁ এটা সত্যি যে আমি আপুর বাবাকে আগে একবার দেখেছি। কিন্তু তিনি যে আপুর বাবা সেটা জানতাম না, আমি ঢাকায় এসে জানতে পেরেছি।

– আমি স্পেশাল ভাবে দুটো মানুষকে তোমাদের দুজনের পিছনে রেখেছিলাম ফেরদৌস।

– মানে? দুজনের পিছনে মানে কি? আমি আর সুমনা?

– হাহাহা, মুখ ফস্কে সুমনার নাম বের হয়ে গেল?

– কিন্তু এছাড়া তো কারো সঙ্গে কথা বা পরিচয় নেই আমার।

– তোমার সঙ্গে কার পরিচয় আছে তা দিয়ে তো আমি লোক নিয়োগ করিনি।

– তাহলে?

– তোমার পিছনে যাকে নিয়োগ করা হয়েছে সেই বের করেছে তোমার আপুর বাসায় শাকিলার বাবার প্রবেশ করা ইত্যাদি ইত্যাদি।

– দেখুন সেটা আমার দুলাভাইয়ের অপরাধ ছিল তাই সে বিষয় কিছু বলার ছিল না। আর সেদিনের পর থেকে আমি আমার আপু দুলাভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতাম না।

সাজু এবার সানোয়ারের দিকে তাকিয়ে বললো,

– সানোয়ার ভাই এবার আপনার লিস্টটা আমার কাছে দেন তো।

সানোয়ার তার লিস্ট বের করে দিল, ৭ টা নাম সেখানে লেখা আছে। সাজু সেগুলো চোখ বিলিয়ে তারপর বললো,

– সাতটা মহাদেশ থেকে সাতটা নাম লিখে নিয়ে এসেছেন, কিন্তু আপনার নাম কোই?

– সানোয়ার বললো, মানে? আমার নাম কেন থাকবে এখানে?

– আশ্চর্য, আঙ্কেলের সঙ্গে তার ডানহাত হিসেবে কাজ করবেন, রাতারাতি টাকা ইনকাম করবেন আর নিজের নাম ব্যবহার করবেন না?

– আমি কখনো তার সঙ্গে এসব বিষয় যোগাযোগ করতাম না, শাকিলা আমার বন্ধু তাই তার বাবার পরিচয়ে তাকে চিনি।

– তাহলে প্রতিদিন এতো কথা কিসের জন্য হতো জানতে পারি ? এমনকী খুন হবার রাতে বাসায় বসে তিনি যাকে কল করেছে সেই ব্যক্তি আপনি। মানে সুমনা সেদিন রাতে আপনার সঙ্গেই কথা বলতে শুনেছে।

– আঙ্কেল আমাকে কল করতেন শাকিলাকে বোঝানোর জন্য। সাজ্জাদকে ডিভোর্স দিয়ে সে যেন তার বাবার কথা শোনে সেটাই বোঝানোর জন্য তিনি বলতেন।

– আজকে সকালে আপনি হাসপাতালে এসেছেন তাই না?

– হ্যাঁ এসেছিলাম, হাসপাতালের নিচে শাকিলা দাঁড়িয়ে আছে দেখে অবাক হলাম। কারণ তাকে জেল থেকে বের করা হয়েছে জানতাম না, আমি শুধু দেখা করতে চেয়েছিলাম।

– সাজু বললো, শাকিলা আপনি কিন্তু আমাকে বলেন নাই সকাল বেলা সানোয়ার এসেছিল।

– আপনি তো জিজ্ঞেস করেননি সাজু ভাই।

– তাহলে এখন বলো সানোয়ার হোসেনের সঙ্গে তোমার কি কথা হয়েছে?

– আমরা একসঙ্গে সিড়ি দিয়ে উঠছিলাম, হঠাৎ করে সানোয়ারের কল আসে। আর সানোয়ার সেখান থেকেই বিদায় নিয়ে চলে যায়।

– আপনার সেই জুস আর খাবারের প্যাকেট কার কাছে ছিল? আপনার কাছে নাকি সুমনা আর ফেরদৌস এদের দুজনের কাছে।

– আমার কাছেই ছিল, কিন্তু সিড়ি দিয়ে ওঠার সময় সানোয়ার বললো আমার কষ্ট হবে তাই সে ওটা নেবে।

– বাহহ, আর তখন দৃষ্টির অগোচরে জুসের মধ্যে বিষাক্ত ওষুধ মেশানোর কাজটা করা হয়েছে। তারপর সে মোবাইলে কল আসার অভিনয় করে তোমার সঙ্গে বিদায় নিয়ে চলে যায়। কারণ সে জানতো যে বিষাক্ত ওষুধ খাওয়ানোর দায়িত্ব তুমি পালন করবে।

সবাই হা হয়ে গেল, সানোয়ার সেই মুহূর্তে একটা অপ্রত্যাশিত কাজ করে ফেললো। পকেট থেকে একটা পিস্তল বের করে তার কাছেই থাকা সুমনার গলায় ধরলো।

সাজু শান্ত গলায় বললো, এমনিতেই একটা খুনের দায় আপনার ঘাড়ে আছে। আরেকটা ভুল করে সেটা ভারি করবেন না, সাজ্জাদকে খুনের পরিকল্পনা করা উচিৎ ছিল না সানোয়ার হোসেন সাহেব। তাহলে আরো কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে চলতে পারতেন আপনি। আমি দ্বিতীয় অনুসন্ধান করতে লোক দিছিলাম আপনার পিছনে। একজন সবসময় ফেরদৌসের তথ্য বের করতো আর অন্য জনে আপনার তথ্য বের করতো। আপনি যখন হাসপাতালে গেছেন বা শাকিলার সঙ্গে দেখা করে কথা বলেছেন সেই মেসেজ আমার কাছে এসেছে কিন্তু দেখতে দেরি হয়ে গেছে। আমি মেসেজ চেক করেছি ওসি সাহেব কল করার পরে, ততক্ষণে শাকিলা জুস খাইয়ে দিয়েছে। কিন্তু মেসেজ পেলে ও বুঝতে পারতাম না কারণ সে শুধু লিখেছেন যে আপনি হাসপাতালে গিয়ে শাকিলার সঙ্গে দেখা করে চলে এসেছেন। কিন্তু আমি যখন হাসপাতাল এ গিয়ে জানতে পারলাম তখন মেসেজ এর কথা মিলিয়ে নিলাম। তখন ওসি সাহেব ও শাকিলাকে সামনে রেখে সাজ্জাদকে দিয়ে নাটক করলাম। বাসায় একটা ক্যামেরা আছে বলে তাদের নিয়ে এলাম, কিন্তু সে কথা আপনার কাছে পৌঁছাল না। তাই বাধ্য হয়ে নিজে কিন্তু কল দিয়ে আপনাকে এখানে নামের লিস্ট নিয়ে আসতে বলেছি।
যাইহোক, এবার বলেন সেই রাতে কি কি করেছেন আর কীভাবে করেছেন?

– সানোয়ার হোসেন কিছু বলতে যাবেন তখনই তার অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা ফেরদৌসের সঙ্গে আসা পুলিশ তার হাতের বন্দুক দিয়ে আঘাত করলো। সানোয়ার হোসেন মাটিতে পড়ে গেল, পিস্তলের শব্দ হলো, ফেরদৌস লাফ দিয়ে তাকে চেপে ধরলো। ওসি সাহেব দ্রুত পিস্তল কেড়ে নিল।

অসহায় হয়ে বসে আছে সানোয়ার, বাড়ির মালিক ইতিমধ্যে এসে গেছে। সাজু ভাই কাচের গ্লাসে দুধ খাচ্ছে, দুধ বানিয়ে এনেছে শাকিলা। চা তৈরি করার জন্য যে প্যাকেটের দুধ ছিল আপাতত সেটা দিয়ে চলছে।

– সাজু বললো, সানোয়ার সাহেব আমরা কিন্তু আপাতত আপনার কাছে শুনতে চাই। আদালতে তো অবশ্যই বলবেন কিন্তু তার আগে আমরা একটু জানতে চাই।

– সানোয়ার বলতে শুরু করলো, আঙ্কেলের সঙ্গে আমি এই কাজে জড়িত প্রায় দেড় বছর ধরে। সবসময় আমিই আমাদের বয়সী নেশা করতো এমন মানুষ যোগাড় করতাম। সবকিছু খুবই গোপনভাবে চলছিল, কিন্তু সেদিন রাতে হঠাৎ করে কল দিয়ে বললো শাকিলার বাসায় যেতে হবে। আমি বা আঙ্কেল কেউ জানতাম না শাকিলা বাসায় নেই, আঙ্কেলের টার্গেট ছিল বাসার মধ্যে কিছু মাদক লুকিয়ে রাখবেন। তারপর পুলিশের মাধ্যমে তাকে ফাঁসানো হবে।

কিন্তু আমরা বাসায় গিয়ে দেখি বাসা তালাবদ্ধ, আঙ্কেল তখন পকেট থেকে চাবি বের করে বললো ” কপাল ভালো যে চাবি নিয়ে এসেছি, কিন্তু এতো রাতে দরজা তালা ঝুলছে কেন? ” আমরা ভিতরে প্রবেশ করলাম, বেডরুমে গিয়ে আলমারির চাবি খুঁজতে লাগলেন আঙ্কেল। হঠাৎ করে বালিশের তলায় চেকবই পেল, আমাকে দেখালেন সেই চেকবই। আমি যখন দেখলাম সবগুলোই সই করা আছে তখন উন্মাদ হয়ে গেলাম। বললাম যে ৫০-৫০ ভাগ হবে। কিন্তু আঙ্কেল এক টাকাও দেবে না বলেই আমার মাকে তুলে গালি দিল। তখনই আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে তাই রান্না ঘরে গিয়ে খুঁজে খুঁজে ছুরি বের করলাম। ড্রইং রুমে এসে আঙ্কেলকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ছুরি চালিয়ে দিলাম। একটা চিৎকার তিনি করেছিলেন তখন কিন্তু বাহিরে শব্দ যায় নাই।

আমি আঙ্কেলের লাশ রেখে বাতি বন্ধ করে বের হলাম আর তখনই সিড়ি বেয়ে কারো উপরে ওঠার শব্দ পেলাম। উঁকি দিয়ে দেখি সাজ্জাদ আসছে, আর তখনই ভয় পেলাম। আমি আবার রুমের মধ্যে প্রবেশ করলাম, একটা লোহার রড আগেই দেখেছিলাম সেটা হাতে নিলাম। সাজ্জাদ প্রবেশ করতেই তাকে আঘাত করি, সাজ্জাদ মাটিতে লুটিয়ে পরে। তারপর সেই ছুরি ও রডের মধ্যে আমার হাতের ছাপ মুছে নিলাম আর সাজ্জাদের হাত দিয়ে ছাপ দিলাম।

– সাজু বললো, আপনি তো শিক্ষিত মানুষ তাহলে আপনার তো জানা দরকার ছিল যে এতগুলো টাকার ব্যাপারে ব্যাঙ্ক থেকে একাউন্টের মালিকের কাছে কল দিবে।

– ওসি সাহেব বললেন, ওর কিছু জানতে হবে না, যা জানানোর সবকিছু থানায় গিয়ে জানাবো।

– ঠিক আছে তাই করুন, আর শাকিলা মেডাম আপনি হাসপাতালে চলে যান। সাজ্জাদ ভাইকে বলবেন সবকিছু, সে সুস্থ হয়ে বাসায় এলে আমি একদিন এসে দেখা করে যাবো৷

★★

কেবিনে বিছানায় শুয়ে আছে সাজ্জাদ, তার বুকে হাত দিয়ে একটা আরেকটা হাত মাথায় রেখে বসে আছে শাকিলা। সুমনা ফেরদৌস ও সুমনার মা দাঁড়িয়ে আছে কাছেই, সাজ্জাদের মুখে সামান্য হাসি। শাকিলার চোখে পানি, সে কাঁদছে, তার একচোখে বাবা হারানোর যন্ত্রণা আরেক চোখে স্বামী সুস্থ হবার আনন্দ।

চট্টগ্রামগামী ” ইউনিক ” পরিবহনে বসে আছে রামিশা, সে চট্টগ্রামে চলে যাচ্ছে। তাকে বাসে তুলে বিদায় দিতে এসেছে সাজু ভাই, রামিশা বারবার সাজুর দিকে তাকাচ্ছে।

– সাজু ভাই… মেলা মেলা ধন্যবাদ।

– কেন?

– আমাকে আপনার এমন একটা চমৎকার রহস্য সমাধানের সঙ্গী করার জন্য। আমি কখনো ভাবিনি যে আপনার সঙ্গে এভাবে একসঙ্গে কোন খুনের রহস্যে জড়াবো।

– তাই?

– হ্যাঁ তাই, মনে হচ্ছে একটা স্বপ্ন দেখে এলাম। কেমন অদ্ভুত সবকিছু।

– যদি এমন আবারও কোন মামলার সন্ধান পাই তাহলে তোমাকে বলবো। একটা মেয়ে সঙ্গে নিয়ে রহস্য খোঁজার মজাই আলাদা।

– আমার খুব আফসোস লাগে সাজু ভাই, আমি যদি আপনার সেই ” সরি আব্বাজান ” রহস্যের সমাধান করার সঙ্গী হতে পারতাম। কারণ সেই ঘটনা আজও আমার মনে পরে, খুব মনে পরে।

– আমি চট্টগ্রামে গেলে তোমাকে জানাবো, তুমি ভালো থেকো সবসময়।

– আপনিও ভালো থাকবেন, আর সবচেয়ে ভালো হতো একটা বিয়ে করে জীবন সাজালে।

– হাহাহা, আচ্ছা সেটাও জানাবো।

#সমাপ্ত
লেখাঃ-মোঃ সাইফুল ইসলাল সজীব।

About admin

Check Also

তাকিয়ে থাকলেই ঘুরবে মাথা! বলুন তো ছবিতে আসল চোখ-কান-ঠোঁট কোনগুলো?

অপটিক্যাল ইলিউশন নিয়ে নানান খেলা সোশ্যাল মিডিয়াতে বেশ ট্রেন্ডিং। মানুষ এই ধরনের ছবি দেখে শুধু …