ভ্রমণের উপকারিতা: দেশ বিদেশ ভ্রমণ আপনার মধ্যে কি পরিবর্তন আনতে পারে?

ভ্রমণের উপকারিতা: ভ্রমণ মানে শুধু সৈকতের নয়নাভিরাম দৃশ্য চোখে নিয়ে প্রিয় পানীয়তে চুমুক দেওয়া নয়। নয় অস্ত যাওয়া সূর্যটাকে হা করে গিলে ফেলার ভঙ্গিমাকে ফ্রেমবন্দি করে ইনস্টাগ্রামে আপলোড করা। ভ্রমণের উপকারিতা তখনই অনুধাবন করা যায়, যখন জীবনের ঝক্কি-ঝামেলা পেছনে ফেলে প্রিয় গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়া হয়। ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে জীবনের ভারিক্কি মতবাদ নিয়ে জম্পেশ আড্ডার আমেজের রদ বদলটা ভ্রমণের ভূমিকা সরবে ঘোষণা করে। চলুন জেনে নেয়া যাক, দেশ বিদেশ ভ্রমণ একটা জীবনকে আমূল বদলে দিতে কতটুকু প্রভাব ফেলে।

জীবনের নানা ক্ষেত্রে ভ্রমণের উপকারিতা

মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ থেকে মুক্তি: মাত্র তিন দিনের একটি স্বল্পমেয়াদী ছুটি যে কোন যান্ত্রিকতায় আবদ্ধ অনুভূতিকে স্বাধীনতা এবং সুস্থতায় রূপ দিতে ইতিবাচক এবং তাত্ক্ষণিক প্রভাব ফেলে। অধিকন্তু, বাড়িতে ফিরে আসার পরেও এই উপকারী প্রভাবগুলো বেশ কিছু দিন স্থায়ী হয়।

ব্যাপারটাকে চলন্ত বাসের গতি জড়তার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। চলন্ত বাস আচমকা ব্রেক কষলে শরীরের উপরের অংশ স্বাভাবিকভাবেই সামনের দিকে হেলে পড়ে। এই প্রাকৃতিক কার্যকলাপটিই ঘটে ভ্রমণের সময়। নিত্য অস্থিরতা থেকে হঠাৎ দু-একদিনের ভ্রমণ স্থিরভাবে জীবনটাকে উপভোগ করতে দেয়। এ সময় সেই গতি জড়তাটা পুরোটাই কাটিয়ে উঠেন ভ্রমণকারি। এটি মানসিক প্রশান্তি বৃদ্ধির প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।

সুস্বাস্থ্যের স্থায়ীত্ব: মনের পাশাপাশি ভ্রমণ দেহের সুস্থতার উপরও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। অবশ্য ভ্রমণের সময় ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, ভ্রমণ শারীরিক অনুশীলনে অভ্যস্ত হওয়ার একটি দুর্দান্ত সুযোগকে উন্মুক্ত করে। এর অর্থ হতে পারে সারাদিন ধরে শহরের চারপাশে হাঁটা বা কায়াকিং, হাইকিং এবং সাঁতার কাটা। ভ্রমণ হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।

গ্লোবাল কমিশন অন এজিং এবং ট্রান্সআমেরিকা সেন্টার ফর রিটায়ারমেন্ট স্টাডিজ একটি সমীক্ষা প্রকাশ করে। সেখানে দেখা যায়, যে পুরুষ এবং মহিলারা ছয় বছরে দুবার ভ্রমণ করেন, তাদের চেয়ে যারা এক বছরে দুবার ভ্রমণ করেন, তাদের হার্ট অ্যাটাক বা অন্য হৃদরোগে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।

ভ্রমণের উপকারিতা

অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সৃজনশীলতা বৃদ্ধি: ভ্রমণের ফলে সৃষ্ট অভিজ্ঞতাগুলো শুধুই স্মৃতির অবতারণা করে না। মস্তিষ্ককে সদা সচেতন রাখার মাধ্যমে মানুষের উদ্ভাবনী হওয়ার ক্ষমতাকেও বাড়িয়ে দেয়। ভ্রমণের সময় থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা, নতুন রীতিনীতির সাথে পরিচিত হওয়ার সাথে যা আগে কখনো করা হয়নি তার সাথে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হয়।

এটি ব্যক্তির চিন্তাভাবনা এবং নির্দিষ্ট পরিস্থিতিকে মোকাবেলার জন্য তার ভেতরকার সৃজনশীলতাকে উদ্দীপিত করে। চিরচেনা বৃত্তবন্দি-সদৃশ পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আসাটা বাস্তব দৃষ্টান্তের মাধ্যমে শিখিয়ে দেয় যে, সবকিছুরই একটি বিকল্প আছে।

ভ্রমণ এমন একটি অবস্থা যা প্রতিটি ইন্দ্রিয়কে স্পর্শ করে। নতুন দৃশ্য আর খাবার তো আছেই; তার পাশাপাশি নতুন সুর, নতুন গন্ধ এমনকি নতুন সম্পর্ক একটি শক্তিশালী সংবেদনশীলতার জন্ম দেয়। এগুলো যে কোন সমস্যা সমাধানের সময় নতুন ভাবে ভাবনার রসদ যোগায়। অভিনব যুক্তি, বিশেষায়িত পরিকল্পনা, দ্রুত শিখে নেয়ার প্রবণতা সব কিছু নতুন সিদ্ধান্তের দিকে ধাবিত করে। এক কথায় যত বেশি ভ্রমণ করা হবে, ভ্রমণকারি তত বুদ্ধিমান হবেন।

আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি: ভ্রমণ একজন মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের আস্থা অর্জনের জন্য প্রেরণা যোগায়। বিশদ অভিজ্ঞতা সুদূরপ্রসারি চিন্তা করতে সাহায্য করে। কর্মজীবনের এর প্রভাব অপরিসীম, কেননা কর্মক্ষেত্রের বিস্তারের জন্য প্রয়োজন বহুজাতি, বহু সংস্কৃতির সংমিশ্রণ।

ঘন ঘন ঘোরাঘুরি অপরিচিত কারখানা বা ট্রেড শোয়ের প্রবেশদ্বারে কড়া নাড়ার যাবতীয় ভয় কর্পূরের মত উড়িয়ে দিতে পারে। ভ্রমণের ফলে বিচিত্র পৃথিবীতেও এমন কিছু জায়গার সন্ধান পাওয়া যায় যেগুলো বিভিন্ন দেশে একই রকম। স্বাভাবিক ভাবেই একই রকম পরিবেশ অজানা দেশে পেলেও সেখানে মানিয়ে যেতে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় না।

তাছাড়া একদম নতুন জায়গা খাপ খাইয়ে নিতে ঠিক কতটুকু সময় লাগছে সে বিষয়ে সম্যক ধারণা হয়ে যায়। ফলে একজন পর্যটক এমন জায়গায় যেতেও পিছপা হননা যে জায়গার ব্যাপারে কোথাও থেকে কোন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।

অধিক বন্ধুত্বপূর্ণ মানসিকতা: যে ব্যক্তি পৃথিবীর যত বেশি মাইল পথ অতিক্রম করেছে, সেই সংখ্যার থেকেও তার বন্ধু সংখ্যা বেশি। এটি জটিল কোন অঙ্ক নয়; বরং সেই বন্ধুরা শুধু চেনামুখের থাকে না, বিভিন্ন বিপদে-আপদে তাদের সাহায্যও পাওয়া যায়। বছরে যিনি দু’একবার ভ্রমণের জন্য ঘুরতে বের হন এমন মানুষের থেকে যিনি ঘন ঘন ঘুরে বেড়ান এমন মানুষের কথায় যে কেউ সহজেই বুদ হয়ে যান।

গহীন শ্বাপদসংকুল জঙ্গলে এক রাত, খরস্রোতা কোন নদীর পাশে বসে ভবঘুরেদের সাথে আড্ডা, দুর্গম উপত্যকার লেকের পানিতে গোসলের গল্প শোনার ভাগ্য সব সময় সবার হয়ে ওঠে না। তাছাড়া প্রতিটি এলাকার স্থানীয় লোকেরা তাদের থেকে ভিন্ন অন্য কোন জনগোষ্ঠীর ভয়-দুঃখ-আনন্দের কথা শুনতে পছন্দ করেন।

উন্নত কর্মজীবন: অফিসের চারা দেয়ালের মধ্যবর্তী দূরত্ব যতই হোক না কেন, তাতে মনোরম লেক আর মাথার উপর আকাশ না থাকলে কোন লাভ নেই। অনেকে কাজের পরিবেশ ভালো করার জন্য ডেস্কে বা অফিসের দেয়ালে প্রেরণামূলক পোস্টার লাগান। কেউ কেউ ইউটিউবে প্রেরণামূলক ভিডিও দেখেন। কিন্তু এক সময় এসব কিছুই যেয়ে মিশবে বিরক্তিতে। কারণ এগুলো পুনরাবৃত্তিমুলক ক্রিয়াকলাপ।

তাই যে নিয়োগকর্তারা সুস্থ কর্মক্ষেত্র চর্চা করেন তারা কর্মীদেরকে পেইড ভ্যাকেশন বা অতিরিক্ত বোনাস হিসেবে কোথাও ঘুরে আসতে অফার করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই অফারগুলো থাকে দেশের বাইরে ভ্রমণের। শুধু মানসিক প্রশান্তি-ই নয়, ভ্রমণকারি কর্মীরা তাদের সৃজনশীলতা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রতিষ্ঠানকে আরো লাভজনক কাজ উপহার দিতে পারেন।

দৈনন্দিন জীবনের চক্র থেকে পরিত্রাণ: ভ্রমণ মাত্রই বৈচিত্র্যের অবগাহন। দৈনন্দিন জীবনের তাড়াহুড়ো থেকে বেরিয়ে আসাতে এর কোন বিকল্প নেই। ঘড়ির কাটায় বাঁধা জীবন থেকে মুক্ত করে দেশ-বিদেশ ঘোরাঘুরি এক উন্নত জীবনের স্বপ্ন যাপন করতে শেখায়। যারা ৯ থেকে ৫টার গোলক ধাঁধাঁর নৈরাশ্যে দিন কাটাচ্ছেন তাদের একমাত্র ওষুধ ভ্রমণ।

এখানে ভারসাম্যে নিয়ে আসতে হবে জীবনে একের পর এক অর্জনের পেছনে ছুটে যাওয়াটাকে। নতুবা জীবনের আসল উদ্দেশ্য হিসেবে শান্তিতে বেঁচে থাকা আর আর্থিক উন্নতির মাঝে এক বিশাল সীমারেখা রচিত হবে। তখন জীবনের শেষ প্রান্তে হাজার অর্জনের পরে একরাশ অপ্রাপ্তির কষ্ট থেকে যাবে।

যোগাযোগ এবং ভাষার দক্ষতা: দেশ-বিদেশ ঘোরা মানে নতুন মানুষের সাথে পরিচিতি; নতুন ভাষার সাথে পরিচিতি। অজানা দেশটিতে চলাফেরা করার তাগিদে অনেকটা বাধ্য হয়েই প্রকৃতিগত ভাবে শিখে নিতে হয় সে দেশের ভাষা। এভাবে যত দেশ ঘোরা যায়, তত ভাষা সম্পর্কে জানা যায়।

এখানে এই শিখনটি একদম ব্যাকরণসহ ভাষা শিক্ষার দাবি করে না। স্থানীয়দের মূল্যবোধ, চাওয়া-পাওয়া, বোঝাপড়া বোঝার জন্য প্রয়োজনীয় শব্দগুলোই এখানে মূখ্য বিষয়। এভাবে বহু ভাষায় দক্ষতা সম্পন্ন ব্যক্তি যে কোন প্রতিষ্ঠান এবং দেশের জন্য সম্পত্তি সদৃশ।

জীবনের জন্য নতুন উদ্দেশ্য ও কাজের সন্ধান লাভ: কোন এক ভ্রমণ কখনো জীবন পরিবর্তনকারী অভিজ্ঞতা হতে পারে। নতুন চাকরির খোঁজ বা ব্যবসা শুরু করার মত জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনকালে ভ্রমণ সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সঠিক দিকনির্দেশনা, উপযুক্ত রশদ এবং কাজের নতুন ধারণা পাওয়ার মাধ্যমে একজন পর্যটক উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীতে পরিণত হতে পারে। পৃথিবীর অধিকাংশ বড় বড় প্রতিষ্ঠানের স্থাপিত হওয়ার সাথে মিশে আছে এরকম হাজারো ভ্রমণ গল্প।

প্রকৃতি ও পৃথিবীর সৌন্দর্য্যে অবগাহন: বিস্তৃত ফসলের মাঝে ঘুরে বেড়ানো, নীল রঙের কোন লেকের শান্ত পানিতে ডুব দেয়া বা পর্বত চূড়ায় মেঘের ধোয়াশায় নিজের ঝাপসা হাতের আঙ্গুল গোনার বিনিময় করা কোন কিছু দিয়েই সম্ভব নয়। এই সৌন্দর্যপ্রীতি শুধু প্রকৃতির প্রশংসা করার জন্য নয়। গোটা বিশ্ব ভ্রম্মান্ডের তুলনায় নিরন্তর প্রাপ্তির পেছনে ছুটে যাওয়া দেহটা যে কত ক্ষুদ্র তা অনুধাবন করা।

এই শ্বাসরুদ্ধকর আশ্চর্যগুলো জীবনটাকেও একইভাবে সুন্দর করার জন্য দৃষ্টি খুলে দেয়। মানুষের প্রতিটি কর্মকান্ডের উপর নির্ভর করে এই প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য। তাই এগুলো রক্ষার্থে ভ্রমণপিপাসুরা অনেক যত্নবান হয়ে ওঠেন। নিজের ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য গভীর উপলব্ধিতে এই নিঃসীম সৌন্দর্য্যের প্রতি তাদের ঔদাসিন্য থাকে না।

ভ্রমণের উপকারিতা শেষাংশ: সর্বোপরি, ভ্রমণের উপকারিতা নতুন এক জীবন ধারণের মাইলফলক স্থাপন করে। দেশ-বিদেশ ঘোরার ব্যাপারে যে তথাকথিত ভয়টি কাজ করে তা হলো ঘুরে বেড়াতে অনেক অর্থের প্রয়োজন। যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ থাকলে নিঃসন্দেহে বেশি দেশ ভ্রমণ সম্ভব। কিন্তু এখানে ভয়ের ব্যাপারটি আসে ভূল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। সমাজে সর্বজনবিদিত তথাকথিত জীবনের জন্য সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েন বড় ত্যাগ স্বীকারে, বড় বিনিয়োগে। তা করতে যেয়ে এমনকি কখনো প্রাণ ওষ্ঠাগত হওয়ার পরিক্রম হয়।

এক্ষেত্রে ভ্রমণ নিছক বিনোদন হিসেবেই বিবেচিত হয়। কিন্তু ভ্রমণকে উপজীব্য জীবনও হতে পারে সেই সমাজ স্বীকৃত উন্নত মানের। তার জন্য সেই বিনিয়োগ, সেই ত্যাগ-তিতিক্ষাগুলো পরিকল্পিত উপায়ে ধাবিত করতে হবে ভ্রমণকে উদ্দেশ্য করে।

About admin

Check Also

ই পাসপোর্ট জেনে নিন কোন রঙের পাসপোর্ট কাদের জন্য

ইলেকট্রনিক পাসপোর্ট যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে আজ থেকে ই-পাসপোর্টে যাত্রা …