বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।বুধবার রাতে সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার পর এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন সংগঠনটির সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি- এই সরকারেরই আইনগত, গণতান্ত্রিক ও নৈতিক বৈধতা নেই। যাদের নিজেদেরই বৈধতা নেই, তাদের এই হাস্যকর কর্মকাণ্ড নিয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ চিন্তিত নয়।’
সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘এই সরকারের হাতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মী এবং পুলিশের রক্তের দাগ লেগে রয়েছে। নিজেদের গণহত্যার দায় আমাদের ওপরে চাপানোর জন্যেই এই সিদ্ধান্ত তারা নিয়েছে।’
ছাত্রলীগ সভাপতি আরও বলেন, ‘যেই সরকারের বৈধতা নেই, তাদের নিষিদ্ধ করার ঘোষনায় আমাদের কার্যক্রম বন্ধ থাকবে না। ছাত্রলীগ তাদের সকল কার্যক্রম অব্যহত রাখবে।’
এসময় বর্তমান সরকারকে জামায়াত-রাজাকারদের সরকার বলেও আখ্যায়িত করেন তিনি।
এদিকে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনের বলা হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে বিশেষ করিয়া বিগত ১৫ বৎসরের স্বৈরাচারী শাসনামলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ হত্যা, নির্যাতন, গণরুম কেন্দ্রিক নিপীড়ন, ছাত্রাবাসে সিট বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নসহ নানাবিধ জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল এবং এই সম্পর্কিত প্রামান্য তথ্য দেশের সব প্রধান গণমাধ্যমে প্রকাশিত হইয়াছে এবং কিছু সন্ত্রাসী ঘটনায় সংগঠনটির নেতাকর্মীদের অপরাধ আদালতেও প্রমাণিত হইয়াছে।
এতে বলা হয়, যেহেতু ১৫ জুলাই ২০২৪ তারিখ হইতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রী ও সাধারণ জনগণকে উন্মত্ত ও বেপরোয়া সশস্ত্র আক্রমণ করে শতশত নিরপরাধ শিক্ষার্থী ও ব্যক্তিদের হত্যা করেছে এবং আরও অসংখ্য মানুষের জীবন বিপন্ন করেছে এবং যেহেতু সরকারের নিকট যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ রয়েছে যে, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক, ধ্বংসাত্মক ও উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী কাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, সরকার ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯’ এর ধারা ১৮ এর উপ-ধারা (১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করল এবং উক্ত আইনের তফসিল-২ এ ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’ নামীয় ছাত্র সংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্ত্বা হিসাবে তালিকাভুক্ত করল। ইহা অবিলম্বে কার্যকর হবে।
নিষিদ্ধ হওয়ার খবরে ছাত্রলীগের বিবৃতি
ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ অভিযোগ করে তা প্রত্যাখ্যান করেছে আওয়ামী লীগের ভাতৃপ্রতিম ছাত্র সংগঠনটি। একইসঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘অবৈধ, অসাংবিধানিক, দেশবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে সরকারের পদত্যাগও দাবি করেছে সদ্য নিষিদ্ধ সংগঠনটি।
বুধবার (২৩ অক্টোবর) রাতে সংগঠনটির সভাপতি সাদ্দাম হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান সাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ দাবি জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, ‘বাংলা ভাষা, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সাম্য ও মানবিক মর্যাদায় যুগে যুগে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রয়েছে লড়াকু ইতিহাস। ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬ এর ছয়দফা, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব ও আত্মদান থেকে শুরু করে পরবর্তীতে জনগণের সকল আন্দোলনেও যুগপৎ স্রষ্টা হিসেবে ভূমিকা রেখেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। এছাড়াও গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ, সাম্য-মানবিক ও কল্যাণধর্মী রাষ্ট্র বিনির্মাণে সোচ্চার থেকেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।’
কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রলীগের ভূমিকা তুলে ধরে বলা হয়, ‘সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষার্থীদের অন্তরের আকুতিকে অনুধাবন করে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালীন সময়ে একটি যৌক্তিক সংস্কার ও সমাধানের জন্য সর্বাত্মক ভূমিকা রেখেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। কিন্তু উদ্দেশ্যমূলকভাবে ‘‘মেটিকিউলাস প্ল্যানের’’ অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে শিক্ষার্থীদের বিপরীতে দাঁড় করানোর অপচেষ্টা করেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থী ও রাষ্ট্রবিরোধী কুচক্রী স্বার্থান্বেষী মহল।’
অন্তর্বর্তী সরকারকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে আরও বলা হয়, ‘বর্তমানে দেশের বিদ্যমান সংকটে যখন দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় ঊর্ধ্বগতি, লাগামহীন অরাজকতা, মব জাস্টিস, হাজার-হাজার দলীয় নেতাকর্মীকে হত্যা, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যর্থতা প্রবল, তখনই এসব লুকানোর জন্য বাংলাদেশ ছাত্রলীগের মতো ঐতিহ্যবাহী একটি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করে জনগণের দৃষ্টিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে অবৈধ ও অসাংবিধানিক সরকার।’
বিজ্ঞপ্তিতে ছাত্রলীগ দাবি করে, ‘দেশরত্ন শেখ হাসিনা যখন ১৫ জুলাই থেকে সংঘটিত প্রতিটি ঘটনার আন্তর্জাতিক তদন্তের আয়োজন করেছিলেন, তখন এই অবৈধ সরকার হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে দায়মুক্তি দিয়ে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনার চেষ্টা করছে তা সর্বৈব মিথ্যা ও বানোয়াট।’
‘এ দেশের ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের প্রতি ইঞ্চি মাটি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের পবিত্র রক্তে রঞ্জিত। যতোদিন বাংলাদেশ থাকবে, লাল-সবুজের পতাকা থাকবে, ‘‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি থাকবে’’, ‘‘জয় বাংলা’’ স্লোগানের প্রকম্পন থাকবে, ততোদিন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ থাকবে অমর, অক্ষয়।’
সংগঠনটি দাবি জানায়, ‘বাংলাদেশ ও এ দেশের মানুষের ভাগ্যের উপর অন্ধকার নিয়ে আসা এই অবৈধ, দেশবিরোধী সরকারকে অবিলম্বে পদত্যাগ করে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তির সরকার প্রতিষ্ঠায় এ দেশের ছাত্র-তরুণ সমাজ, কৃষক-শ্রমিক ও জনতার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।’
আওয়ামী লীগ সরকার পতনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবির মুখে বুধবার ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠন হিসেবে সংগঠনটিকে নিষিদ্ধের কথা জানানো হয়েছে।
ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের খবরে ‘ঈদ মোবারক’ হাসনাতের, বাকিরা যা বললেন
আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেছে সরকার। আজ বুধবার (২৩ অক্টোবর) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধের কথা জানানো হয়েছে।
নিষিদ্ধের খবরে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে এক পোস্টে দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। পেস্টে তিনি লেখেন, ‘ঈদ মোবারক’।
সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুম বলেন, আজ আমাদের জীবনের অন্যতম আনন্দের একটা দিন। ছাত্রলীগ দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার মতো কেউ ছিল না। এই ছাত্রলীগ ১৫ জুলাই আমাদের ওপর হামলা করেছে, সারা দেশে তারা অসংখ্য ছাত্র-জনতাকে শহীদ করেছে। তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ধন্যবাদ জানাই ছাত্রলীগের মতো সন্ত্রাসী সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণার জন্য।
সমন্বয়ক আবু সাঈদ বলেন, আজকে আমরা অনেক বেশি খুশি। কারণ, ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমরা সারা দেশ থেকে ছাত্রলীগ ও তার দোসরদের সমূলে উৎখাত করতে চাই। আজকে ঢাকা শহরের মিষ্টি শেষ হয়ে যাক, তবুও আনন্দ শেষ না হোক।
সমন্বয়ক হাসিব আল ইসলাম বলেন, একজন চারণ কবি বলেছিল ছাত্রলীগ নাকি ছিল, আছে এবং থাকবে। কিন্তু আজ তারা কোথায়? আজ খুনি হাসিনাও নেই, চারণ কবিও নেই, ছাত্রলীগও নেই। তারা বলেছিল তারা নাকি আমাদের ৭ মিনিটে আউট করবে। আজ আমরা দেখেছি, তারা মধুর ক্যান্টিনের সামনে ৪৬ সেকেন্ডে আউট হয়ে গেছে। তারা রাজপথ থেকে সৃষ্টি হয়ে রাজপথ থেকে পালিয়ে গেছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে আর কোনো মুজিববাদের ঠিকানা হবে না। ২৪ বিপ্লব সবাইকে দেখিয়েছে মুজিববাদ দীর্ঘদিন ধরে আমাদের কাছে সত্য ইতিহাস গোপন করে রেখেছিল। কিন্তু এখন তারা আর সেটা পারবে না। আমরা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাদের পরাজিত করেছি। এখন দেশের সব সাধারণ মানুষ লুকায়িত সত্য ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবে।
সমন্বয়ক রিফাত রশিদ বলেন, ৫ আগস্টের পরে ছাত্রলীগ গর্তে লুকিয়েছে। তাদের নেত্রী ভারতে পালিয়ে গেলেও তাদের এ দেশে ফেলে গেছে। দেশের সব ছাত্র-জনতাকে বলতে চাই, আপনারা একটা একটা ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের গর্ত থেকে টেনে তুলে ধোলাই দিয়ে পুলিশের হাতে সোপর্দ করবেন। একজনও যেন আইনের হাত থেকে রক্ষা না পায়।
এর আগে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক শাখা-২ এর দেওয়া এক প্রজ্ঞাপনে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধের কথা জানানো হয়। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে বিশেষ করে গত ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ হত্যা, নির্যাতন, গণরুমকেন্দ্রিক নিপীড়ন, ছাত্রাবাসে সিট বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নসহ নানা ধরনের জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল এবং এ সম্পর্কিত প্রামাণ্য তথ্য দেশের সব প্রধান গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে এবং কিছু সন্ত্রাসী ঘটনায় সংগঠনটির নেতাকর্মীদের অপরাধ আদালতেও প্রমাণিত হয়েছে।
উল্লেখ্য, আজ বুধবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ জানিয়েছিলেন, আমরা গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তি যারা আছি তারা ছাত্রলীগের প্রশ্নে আপোষহীন। গত ১৬ বছরে দেশের ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ যে নৃশংসতা করেছে সেখানে আগামীতে ছাত্রলীগের পুনর্বাসনের ন্যূনতম কোনো সুযোগ নেই। ছাত্রলীগ জঙ্গি সংগঠন হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য যত ধরনের কম্পোনেন্টস প্রয়োজন, সবগুলো এই সংগঠনের রয়েছে।