এখানেই নবীজির দুধমা হালিমার বাড়ি ও শৈশব কাটানো পাহাড়

নবী করিম (সা.) তায়েফ শহর থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে বনু সাদ অঞ্চলে দুধমায়ের ঘরে লালিতপালিত হন। পরে তিনি নবুওয়তপ্রাপ্ত হলে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে তায়েফ যান। তৎকালীন আরবের, বিশেষ করে মক্কার প্রথানুযায়ী সম্ভ্রান্ত পরিবারের শিশুসন্তানদের জন্মের পর মরুভূমির মুক্তাঞ্চলে লালনপালনের ব্যবস্থা করা হতো।

হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আট দিন মতান্তরে দশ দিন বয়সের সময় বনু সাদ গোত্রের হালিমা সাদিয়া তাকে লালনপালনের জন্য তার মা আমেনার কাছ থেকে নিয়ে আসেন।

দুধমা হালিমা যখন হজরত রাসূলুল্লাহকে (সা.) তার ঘরে নিয়ে আসেন তখন পাঁচ বছর বয়সী সায়মা নামে তার এক কন্যাসন্তান ও আবদুল্লাহ নামে একজন দুগ্ধপোষ্য পুত্রসন্তান ছিলো। নবী করিম (সা.) কে লালনপালনের বিষয়ে সায়মা তার মাকে সাহায্য করতেন।

হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) কে গোসল করানো এবং বাইরে হাঁটাচলা করানোর দায়িত্ব সায়মা যত্ন ও পরম স্নেহের সঙ্গে সম্পাদন করতেন। এমনই এক গাছের নিচে চাক করা হয়েছিলো মহানবী সা. এর সীনা। ছবি: মুফতি এনায়েতুল্লাহ হজরত হালিমার ঘরে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আগমনের পর পরিবারটির দারিদ্র্যবস্থা দূর হয়ে স্বাচ্ছন্দ্য আসতে থাকে।

তা ছাড়া দুধমা হালিমা লক্ষ করলেন, যেদিন মা আমেনা শিশু মুহাম্মদকে তার কাছে অর্পণ করলেন, সেদিন তার স্তন দুধে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। তিনি মক্কা থেকে তায়েফ ফেরার পথে লক্ষ করলেন, নবী করিম (সা.) কে বহনকারী অপেক্ষাকৃত দুর্বল উটটি অপরাপর সবল উটের চেয়ে অনেক দ্রুত গতিতে চলছিলো।

নিজ বাড়িতে ফেরার পর তিনি দেখলেন, তার মেষ ও দুম্বাগুলোর ওলান দুধে ভরপুর। সময় তার স্বাভাবিক গতিতে চললেও হালিমার কাছে মনো হলো, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) কে লালনপালনের দুই বছর যেন খুব দ্রুতই পার হয়ে গেছে।

রীতি অনুযায়ী নবী করিম (সা.) কে তার মা আমেনার কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার সময় হলে দুধমাতা হালিমা, দুধভাই আবদুল্লাহ ও দুধবোন সায়মা খুবই দুঃখ-ভারা’ক্রা’ন্ত হয়ে পড়েন।

ঐতিহাসিকরা লেখেন, দুগ্ধপালনরত শিশু মুহাম্মদ (সা.) কে তার স্তন হতে ছাড়িয়ে নেওয়ার সময় মা হালিমার কান্না, আবেগ ও ভালোবাসায় অভিভূত হয়ে মা আমেনা তাকে আরও কিছুকাল তায়েফের বনু সাদ অঞ্চলে লালনপালনের জন্য আবার তার কাছে অর্পণ করেন।

হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তায়েফের বনু সাদ অঞ্চলে মা হালিমার যে দু’টি ঘরে লালিতপালিত হয়েছিলেন, সে দু’টি ঘরের অস্তিত্ব পাহাড়ের পাদদেশে এখনও বিদ্যমান। এখন পাহাড়ের ওপরে মানুষের বসতি থাকলেও, পাহাড়ের পাদদেশে কোনো বসতি নেই।

ছোটচেলায় এ পাহাড়ে খেলতেন মহানবী সা.। ছবি: মুফতি এনায়েতুল্লাহ ঘর দু’টির চার দিকের দেয়াল পাথর দিয়ে ঘেরাও করা। যার আয়তন দৈর্ঘ্যে ১৪ ফুট ও প্রস্থে ৬ ফুট। ঘর দু’টির ছাউনি বর্তমানে নেই।

আগেরকার আরবদের ঘরের ওপর খেজুরপাতার যে ধরনের ছাউনি থাকত, এ দু’টি ঘরের ওপরও অনুরূপ ছাউনি ছিলো। কালের বিবর্তনে সেগুলো হারিয়ে গেছে, আর হারিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক।

হজরত হালিমার ঘর দু’টি দেখার জন্য প্রতিদিন সেখানে প্রচুর মানুষের আগমন ঘটে। তবে সেখানে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভারতীয় উপমহাদেশের লোকজনের আগ্রহই বেশি। কোনো আরবকে সেখানে খুব একটা যেতে দেখা যায় না।

তাদের যুক্তি, হ্যাঁ হতে পারে নবী করিম (সা.) এখানে জীবনের একটি অংশ কাটিয়েছেন। কিন্তু সেই স্থানের সঙ্গে তো ইসলামের কোনো বিধান সম্পৃক্ত নয়। সেখানকার কোনো ফজিলত বা মাহাত্ম্যের কথা আলাদাভাবে নবী করিম (সা.) বলে যাননি। তাই সেই জায়গাকে আলাদাভাবে মূল্যায়ন করার কোনো অবকাশ নেই। তাহলে ওই জায়গাকে ঘিরে নানা ধরনের নতুন নতুন কর্মকাণ্ড ঘটতে থাকবে। যার অনুমোদন ইসলামে নেই।

তারপরও মানুষ দলবেঁধে যান হালিমার বাড়ি দেখতে। স্থানটি তায়েফ শহর থেকে বেশ দূরে। অবশ্য রাস্তা ভালো হওয়ায় সময় বেশি লাগে না। সেখানে আসা-যাওয়ার জন্য ভাড়ায় চালিত ট্যাক্সি, মাইক্রোবাস এমনকি বড় বাসও মেলে।

পাথরের ঘেরাও দিয়ে ঘর দু’টির মেঝেতে জায়নামাজ বিছানো রয়েছে। দর্শনার্থীদের অনেকে সেখানে শোকরিয়া বা কৃতজ্ঞতা আদায়স্বরূপ নফল নামাজ আদায় করেন।

মহানবী সা. এর শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত পাহাড়। ছবি: মুফতি এনায়েতুল্লাহহালিমার বাড়ির পেছনে পাহাড়ের ঢালে একটি বিশাল জায়গা কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে রাখা আছে। মানুষজন বলেন, এখানে নবী করিম (সা.) দুধ ভাইবোনদের সঙ্গে খেলাধুলা করতেন এবং মেষ চরাতেন। সেখানে দেখা গেলো, সবুজ ঘাসের সমারোহ, একপাশে ভুট্টা চাষ হচ্ছে।

মেষ চরানোর জায়গা থেকে বেশ দূরে একটি পাহাড়ি গাছের নিচে মানুষের ভিড়। এখানেও জায়নামাজ বিছানো আছে, মানুষ গাছের নিচে বসে আসেন। ঠিক এই গাছটি নয়, তবে ওখানে একটি গাছের নিচে নবী করিম (সা.)-এর সিনা চাক করার ঘটনা ঘটেছিল।

পাহাড়ি ঢালুপথ বেয়ে নিচে নেমে দেখলাম, অনেক আবেগি মানুষ সেখানে থাকা গাছটির ছাল নিতে নেতে ন্যাড়া বানিয়ে ফেলছে। অনেকে আবার সেথানে আতর ঢেলে দিচ্ছে, কিছু দূরে একটি ঝোপের কাছে দেখলাম এক পাকিস্তানি বসে আতর বিক্রি করছে। কাছে গিয়ে বললাম, ‘ভাইলোগ! তুম ইধারভি আগায়া পায়সা কামানেকে লিয়ে?’ ক্রুদ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে পলিথিনে আতরের পসরা নিয়ে উঠে গেলো সে।

পাহাড়ের পাদদেশে ঝিরঝিরে ঠাণ্ডা বাতাস আলতো করে দোলা দিচ্ছে নাম না জানা গাছের পাতাগুলোকে। আমাদের স্মৃতিতে একে এক ভেসে উঠতে থাকে, এই সেই উপত্যকা যেখানে নবী শিশু জীবনের প্রায় পাঁচটি বছর কাটিয়েছেন।

হ্যাঁ, হতে পারে চিহ্নিত করে রাখা হালিমার ঘর সেই আদিকালের ঘর নয়। কিন্তু এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এখানে বনু সাদের লোকজনের বাস ছিলো। সুতরাং সঙ্গতকারণেই, স্থানটির সঙ্গে মুসলমানদের আবেগ জড়িয়ে আছে, জড়িয়ে ইতিহাসের একটি বিশাল অংশও।

Check Also

Health for Life Nutrition A Guide to Living Well

Health for Life Nutrition A Guide to Living Well

In today’s fast-paced world, maintaining good health can seem overwhelming. But the truth is, a …