সুখী মানুষ নাটকের ব্যাখ্যাসহ আলোচনা – দ্বিতীয় অধ্যায় বাংলা ২য় পরিচ্ছেদ আস-সালামু আলাইকুম প্রিয় শিক্ষার্থী, তোমরা নিশ্চয়ই নাটক দেখেছ। এটা একই সঙ্গে দেখা ও শোনার বিষয়। নাটকে একজনের সঙ্গে অন্যজনের যেসব কথা হয়, সেগুলোকে সংলাপ বলে। চরিত্রগুলোর সংলাপ অথবা পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ভেতর দিয়ে একটি নাটকের কাহিনি গড়ে ওঠে।

এবার আমরা একটি নাটক নিয়ে আলোচনা করব। নাটকটির নাম ‘সুখী মানুষ’। যাঁরা নাটক লেখেন, তাঁদের নাট্যকার বলে। ‘সুখী মানুষ’ নাটকের নাট্যকার মমতাজউদদীন আহমদ। তিনি একজন বিখ্যাত নাট্যকার। মমতাজউদদীন আহমদ ১৯৩৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন।
সুখী মানুষ নাটকের ব্যাখ্যাসহ আলোচনা – দ্বিতীয় অধ্যায় বাংলা ২য় পরিচ্ছেদ
একটি নাটক দেওয়া হলো। নাটকটির নাম ‘সুখী মানুষ‘। এটি মমতাজউদ্দীন আহমদের লেখা। তিনি একজন বিখ্যাত নাট্যকার। তাঁর লেখা বিখ্যাত নাটকের মধ্যে আছে ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’, ‘কি চাহ শঙ্খচিল’। যাঁরা নাটক লেখেন, তাঁদের নাট্যকার বলে। নাটকে একজনের সঙ্গে অন্যজনের যেসব কথা হয়, সেগুলোকে সংলাপ বলে। এই নাটকের সংলাপে প্রমিত ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে।
এই কথা বা সংলাপ যাদের মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয়, তাদের বলে চরিত্র। সুখী মানুষ’ নাটকে অনেকগুলো চরিত্র আছে। তুমি ও তোমার সহপাঠীরা এগুলোর মধ্য থেকে একটি করে চরিত্র বেছে নাও এবং চরিত্র অনুযায়ী সংলাপ পাঠ করো। সংলাপ পাঠ করার সময়ে প্রমিত উচ্চারণের দিকে খেয়াল রেখো।
লেখক-পরিচিতি (Biography)
নামঃ মমতাজউদদীন আহমদ
জন্মঃ ১৮ই জানুয়ারি, ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ জেলায়।
পিতাঃ কলিম উদ্দীন আহমদ।
মাতাঃ সখিনা খাতুন।
স্থায়ী ঠিকানাঃ বজরাটেক, ভোলাহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
শিক্ষাজীবনঃ প্রবেশিকা
ভোলাহাট আর ইনস্টিটিউশন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, (১৯৫১)।
উচ্চ মাধ্যমিক রাজশাহী কলেজ, (১৯৫৪)। স্নাতক সম্মান (বাংলা), রাজশাহী কলেজ, (১৯৫৭)।
স্নাতকোত্তর বাংলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, (১৯৫৮)।
পেশা/কর্মজীবনঃ অধ্যাপনা, বিভিন্ন সরকারি কলেজ। খণ্ডকালীন অধ্যাপক, নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট নাট্যকার ও নির্দেশক।
সাহিত্যসাধনা: নাটকঃ স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা, রাজা অনুস্বারের পালা, সাতঘাটের কানাকড়ি, আমাদের শহর, হাস্য লাস্য “ভাষ্য। গবেষণাগ্রন্থ: বাংলাদেশের নাটকের ইতিবৃত্ত, বাংলাদেশের থিয়েটারের ইতিবৃত্ত। ছোটগল্প: রগড় কাহিনি ও সরস গল্প। উপন্যাস: সজল তোমার ঠিকানা, ওহে নুরুল ইসলাম ইত্যাদি।
সুখী মানুষ নাটকের চরিত্র
মোড়ল বয়স ৫০
কবিরাজ বয়স ৬০
হাসু বয়স ৪৫
রহমত বয়স ২০
লোক বয়স ৪০
সুখী মানুষ নাটকের প্রথম দৃশ্য
[মোড়লের অসুখ। বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে। কবিরাজ মোড়লের নাড়ি পরীক্ষা করছে। মোড়লের আত্মীয় হাসু মিয়া আর মোড়লের বিশ্বাসী চাকর রহমত আলী অসুখ নিয়ে কথা বলছে।]হাসুঃ রহমত, ও রহমত আলী।
রহমতঃ শুনছি।
হাসুঃ ভালো করে শোনো, ওই কবিরাজ যতই নাড়ি দেখুক, তোমার মোড়লের নিস্তার নাই।
রহমতঃ অমন ভয় দেখাবেন না। তাহলে আমি হাউমাউ করে কাঁদতে লেগে যাব।
হাসুঃ কাঁদো, মন উজাড় করে কাঁদো। তোমার মোড়ল একটা কঠিন লোক। আমাদের সুবর্ণপুরের মানুষকে বড়ো জ্বালিয়েছে। এর গোরু কেড়ে, তার ধান লুট করে তোমার মোড়ল আজ ধনী। মানুষের কান্না দেখলে হাসে।
রহমতঃ তাই বলে মোড়লের ব্যারাম ভালো হবে না কেন?
হাসুঃ হবেই না তো। মোড়ল যে অত্যাচারী, মধ্যে থাকলে কাজ হয় পাপী। মনের অশান্তি ওষুধে না। দেখে নিও, মোড়ল মরবে।
রহমতঃ আর আজে-বাজে কথা বলবেন না। আপনি বাড়ি যান!
কবিরাজঃ এত কোলাহল কোরো না। আমি রোগীর নাড়ি পরীক্ষা করছি। রহমত ও কবিরাজ, নাড়ি কী বলছে? মোড়ল বাঁচবে তো!
কবিরাজঃ মূর্খের মতো কথা বোলো না। মানুষ এবং প্রাণী অমর নয়। আমি যা বলি, মনোযোগ দিয়ে তাই শ্রবণ করো।
হাসুঃ আমাকে বলুন। মোড়ল আমার মামাতো ভাই।
রহমতঃ মোড়ল আমার মনিব।
কবিরাজঃ এই নিষ্ঠুর মোড়লকে যদি বাঁচাতে চাও, তাহলে একটি কঠিন কর্ম করতে হবে।
হাসুঃ বাঘের চোখ আনতে হবে? কবিরাজ: আরও কঠিন কাজ।
রহমতঃ হিমালয় পাহাড় তুলে আনব?
কবিরাজঃ পাহাড়, সমুদ্র, চন্দ্র, নক্ষত্র কিছুই আনতে হবে না।
মোড়লঃ আর সহ্য করতে পারছি না। জ্বলে গেল। হাড় ভেঙে গেল। আমাকে বাঁচাও।
কবিরাজঃ শান্ত হও। ও রহমত, মোড়লের মুখে শরবত ঢেলে দাও।
[রহমত মোড়লকে শরবত দিচ্ছে।।হাসুঃ ওই মোড়ল জোর করে আমার মুরগি জবাই করে খেয়েছে। আমি আজ মুরগির দাম নিয়ে ছাড়ব।
মোড়লঃ ভাই হাসু, এদিকে এসো, আমি সব দিয়ে দেবো। আমাকে শান্তি এনে দাও।
কবিরাজঃ মোড়ল, তুমি কি আর কোনোদিন মিথ্যা কথা বলবে?
মোড়লঃ আর বলব না। এই তোমার মাথায় হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করছি, আর কোনোদিন মানুষের ওপর জবরদস্তি করব না। আমাকে ভালো করে দাও।
কবিরাজঃ লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। আর কোনোদিন লোভ করবে?
মোড়লঃ না। লোভ করব না, অত্যাচার করব না। আমাকে শান্তি দাও। সুখ দাও।
কবিরাজঃ তাহলে মনের সুখে শুয়ে থাকো। আমি ওষুধের কথা চিন্তা করি।
মোড়লঃ সুখ কোথায় পাব? আমাকে সুখ এনে দাও।
হাসুঃ অন্যের মনে দুঃখ দিলে কোনোদিন সুখ পাবে না।
মোড়লঃ আমার কত টাকা, কত বড়ো বাড়ি। আমার মনে দুঃখ কেন?
কবিরাজঃ চুপ করো। যত কোলাহল করবে, তত দুঃখ বাড়বে। হাসু এদিকে এসো, আমার কথা শ্রবণ করো। মোড়লের ব্যামো ভালো হতে পারে, যদি আজ রাত্রির মধ্যেই-
রহমতঃ যদি কী?
কবিরাজঃ যদি আজ রাত্রির মধ্যেই-
হাসুঃ কী করতে হবে?
কবিরাজঃ যদি একটি ফতুয়া সংগ্রহ করতে পারো
রহমতঃ ফতুয়া?
কবিরাজঃ হ্যাঁ, জামা। এই জামা হবে একজন সুখী মানুষের। তার জামাটা মোড়লের গায়ে দিলে তৎক্ষণাৎ তার হাড়-মড়মড় রোগ ভালো হবে।
রহমতঃ এ তো খুব সোজা ওষুধ।
কবিরাজঃ সোজা নয়, খুব কঠিন কাজ। যাও, সুখী মানুষকে খুঁজে দেখো। সুখী মানুষের জামা না হলে অসুখী মোড়ল বাঁচবে না।
মোড়লঃ আমি বাঁচব। জামা এনে দাও, হাজার টাকা বখশিশ দেবো।
সুখী মানুষ নাটকে দ্বিতীয় দৃশ্য
[বনের ধারে অন্ধকার রাত। চাঁদের ম্লান আলো। ছোটো একটু কুঁড়েঘরের সামনে হাসু মিয়া ও রহমত গালে হাত দিয়ে ভাবছে।)রহমতঃ কী তাজ্জব কথা, পাঁচ গ্রামে একজনও সুখী মানুষ পেলাম না। যাকেই ধরি, সেই বলে, না ভাই, আমি সুখী নই।
হাসুঃ আর তো সময় নেই ভাই, এখন বারোটা। সুখী মানুষ নেই, সুখী মানুষের জামাও নেই। মোড়ল তো তাহলে এবার মরবে।
হাসুঃ পাওয়া যাবে না। সুখী মানুষ পাওয়া যাবে না। সুখ বড়ো কঠিন জিনিস। এ দুনিয়াতে ধনী বলছে, আরও ধন দাও; ভিখারি বলছে, আরও ভিক্ষা দাও; পেটুক বলছে, আরও খাবার দাও। শুধু দাও আর দাও। সবাই অসুখী। কারও সুখ নেই।
সুখী মানুষ নাটকের ব্যাখ্যাসহ আলোচনা
রহমতঃ আমরাও বলছি, মোড়লের জন্য জামা দাও, আমাদের বখশিশ দাও। আমরাও অসুখী।
হাসুঃ চুপ চুপ! ঘরের মধ্যে কে যেন কথা বলছে।
রহমতঃ ভূত নাকি? চলেন, পালিয়ে যাই। ধরতে পারলে মাহুভাজা- করে খাবে।
হাসুঃ এই যে ভাই। ঘরের মধ্যে কে কথা বলছ? বেরিয়ে এসো।
রহমতঃ ভূতকে ডাকবেন না।
[ঘর থেকে একজন লোক বেরিয়ে এলো।]লোকঃ তোমরা কে ভাই? কী চাও?
হাসু: আমরা খুব দুঃখী মানুষ। তুমি কে?
লোক: আমি একজন সুখী মানুষ।
হাসু : অ্যাঁ! তোমার কোনো দুঃখ নাই?
লোক : না। সারা দিন বনে বনে কাঠ কাটি। সেই কাঠ বাজারে বেচি। যা পাই, তাই দিয়ে চাল কিনি, ডাল কিনি। মনের সুখে খেয়ে-দেয়ে গান গাইতে গাইতে শুয়ে পড়ি। এক ঘুমেই রাত কাবার।
হাসু: বনের মধ্যে একলা ঘরে তোমার ভয় করে না? যদি চোর আসে?
লোক : চোর আমার কী চুরি করবে?
হাসু : তোমার সোনাদানা, জামাজুতা?
[লোকটি প্রাণখোলা হাসি হাসছে।।রহমত: হা হা করে পাগলের মতো হাসছ কেন ভাই!
লোক : তোমাদের কথা শুনে হাসছি। চোরকে তখন বলব, নিয়ে যাও, আমার যা কিছু আছে নিয়ে যাও।
হাসু : তুমি তাহলে সত্যিই সুখী মানুষ!
লোক : দুনিয়াতে আমার মতো সুখী কে? আমি সুখের রাজা। আমি মস্ত বড়ো বাদশা।
রহমত: ও বাদশা ভাই, তোমার গায়ের জামা কোথায়? ঘরের মধ্যে রেখেছ? তোমাকে একশো টাকা দেবো। জামাটা নিয়ে এসো।
লোক : জামা!
রহমত: জামা মানে জামা! এই যে, আমাদের এই জামার মতো জিনিস। তোমাকে পাঁচশো টাকা দেবো। জামাটা নিয়ে এসো, মোড়লের খুব কষ্ট হচ্ছে।
হাসু : মিছে কথা বোলো না।
লোক : মিছে বলব কেন? আমার ঘরে কিছু নেই। সেই জন্যই তো আমি সুখী মানুষ।
সুখী মানুষ নাটকের পাঠসংক্ষেপ
‘সুখী মানুষ’ মমতাজউদদীন আহমদের একটি নাটক। এর দুটি মাত্র দৃশ্য। নাটিকটির কাহিনিতে আছে, মানুষকে ঠকিয়ে, মানুষের মনে কষ্ট দিয়ে, ধনী হওয়া এক মোড়লের জীবনে শান্তি নেই। চিকিৎসক বলেছেন, কোনো সুখী মানুষের জামা গায়ে দিলে মোড়লের অসুস্থতা কেটে যাবে। কিন্তু পাঁচ গ্রাম খুঁজেও একজন সুখী মানুষ পাওয়া গেল না। শেষে একজনকে পাওয়া গেল, যে নিজের শ্রমে উপার্জিত আয় দিয়ে কোনোভাবে জীবিকা নির্বাহ করে সুখে দিন কাটাচ্ছে। তার কোনো সম্পদ নেই, ফলে চোরের ভয় নেই।
সুতরাং শান্তিতে ঘুমানোর ব্যাপারে তার কোনো দুশ্চিন্তাও নেই। শেষ পর্যন্ত সুখী মানুষ একজন পাওয়া গেলেও দেখা গেল তার কোনো জামা নেই। সুতরাং মোড়লের সমস্যার সমাধান হলো না। নাটকের মূল বক্তব্য- সম্পদই অশান্তির কারণ। সুখ একটা আপেক্ষিক ব্যাপার। একজনের অনেক সম্পদ থেকেও সুখ নেই। আবার আরেকজনের কিছু না থাকলেও সে সুখী থাকতে পারে।
সুখী মানুষ নাটকের গুরুত্বপূর্ণ শব্দের অর্থ
অত্যাচারী: যে অত্যাচার করে।
অমর: যার মৃত্যু নেই।
আত্মীয়: পরিবারের ঘনিষ্ঠজন।
কবিরাজ: যিনি চিকিৎসা করেন।
কুঁড়েঘর: খড় দিয়ে ছাওয়া ছোটো ঘর।
কোলাহল করা: বহু লোকের একসাথে কথা বলা।
ছটফট করা: অস্থির হয়ে নড়াচড়া করা।
চাকর: কর্মচারী
জবরদস্তি করা: জোর করা।
তৎক্ষণাৎ: সেই সময়ে।
তাজ্জব কথা: অবাক করা কথা।
দৃশ্য: নাটকের অংশ।
নক্ষত্র: আকাশের তারা।
সুখী মানুষ নাটকের ব্যাখ্যাসহ আলোচনা ভিডিও দেখুন…
নাড়ি পরীক্ষা করা: রোগ নির্ণয় করা।
নিষ্ঠুর: যার মনে মায়া-মমতা কম।
নিস্তার: রক্ষা।
পাপী: যে পাপ করে।
প্রতিজ্ঞা করা: ওয়াদা করা।
ফতুয়া: বখশিশ
বাঘের চোখ আনা: কঠিন কাজ করা।
বিশ্বাসী: যাকে বিশ্বাস করা যায়।
বখশিশ: খুশি হয়ে দেওয়া উপহার।
ব্যামো : অসুস্থতা।
ব্যারাম : অসুস্থতা।
মন উজাড় করে কাঁদা: ইচ্ছামতো কাঁদা।
মানুষকে জ্বালানো : মানুষকে কষ্ট দেওয়া।
মূর্খ : বোকা।
মোড়ল : গ্রামের প্রধান।
ম্লান আলো : সামান্য আলো।
শ্রবণ করা : শোনা।
হাড়-মড়মড় রোগ : রোগের নাম।
হিমালয় : পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের নাম।