খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে কী ঘটেছে, জানাল আইএসপিআর

গত ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি জেলা সদরে মোটরসাইকেল চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে কতিপয় উশৃংখল জনগণের গণপিটুনিতে মো: মামুন (৩০), পিতা: মৃত নুর নবী নামক একজন যুবক নিহত হয়। পরবর্তীতে সদর থানা পুলিশ নিহতের মরদেহ উদ্ধারপূর্বক ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের নিকট হস্তান্তর করে।

এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরদিন (১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪) বিকেলে দীঘিনালা কলেজ হতে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলটি দীঘিনালার বোয়ালখালী বাজার অতিক্রম করার সময় ইউপিডিএফ (মূল) এর কতিপয় সন্ত্রাসী মিছিলের উপর হামলা করে ও ২০-৩০ রাউন্ড গুলি ‍ছুড়ে। এর প্রেক্ষিতে বিক্ষুব্ধ জনতা বোয়ালখালী বাজারের কয়েকটি দোকানে অগ্নি সংযোগ করে।

উল্লেখ্য, সংঘর্ষ চলাকালে উভয় পক্ষের ৬ জন আহত হলে তাদেরকে চিকিৎসার জন্য দীঘিনালা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। পরবর্তীতে সেনাবাহিনীর টহল দল ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং ফায়ার ব্রিগেড ও স্থানীয় জনসাধারণের সহায়তায় আগুন নেভায়।

উপরোক্ত ঘটনার প্রেক্ষিতে খাগড়াছড়ি জেলা সদর, দীঘিনালা, পানছড়ি ও আশেপাশের এলাকা সমূহে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। সেই সাথে কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে ক্রমেই পরিস্থিতিকে আরো উত্তেজনাকর করে তুলে। দ্রুততার সাথে খাগড়াছড়ি জেলার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে জরুরী ভার্চুয়াল সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখ রাত ২২০০ ঘটিকা হতে খাগড়াছড়ি জেলা সদর, দীঘিনালা ও পানছড়িসহ সকল উপজেলায় যৌথভাবে সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সমন্বয়ে টহল দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন কমিউনিটি লিডারদের সাথে আলাপ আলোচনা করে সকল পক্ষকে সহিংস কার্যকলাপ হতে বিরত থাকার পরামর্শ প্রদান করতে বলা হয়।

একই রাতে (১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪) খাগড়াছড়ি জোনের একটি টহল দল ২২৩০ ঘটিকায় একজন মুমূর্ষ রোগীকে স্থানান্তরের সময় খাগড়াছড়ি শহরের স্বনির্ভর এলাকায় পৌঁছালে অবস্থানরত উত্তেজিত জনসাধারণ ইউপিডিএফ (মূল) এর নেতৃত্বে বাধা সৃষ্টি করে। এক সময় ইউপিডিএফ (মূল) এর সন্ত্রাসীরা সেনাবাহিনীর টহল দলের সদস্যদের উপর গুলি করে এবং আত্মরক্ষার্থে সেনাবাহিনী পাল্টা গুলি চালায়।

উক্ত গোলাগুলির ঘটনায় ৩ জন নিহত এবং কয়েকজন আহত হয় বলে জানা যায়।

একই ঘটনার ধারাবাহিকতায় খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়িতে স্থানীয় উশৃংখল জনসাধারণ কয়েকজন যুবকের মোটরসাইকেল থামিয়ে তাদের উপর হামলা ও লাঠিপেটা করে। সেই সাথে উত্তেজিত জনসাধারণ ইউপিডিএফ (মূল) এর নেতৃত্বে ফায়ার ব্রিগেড এর অফিসে ভাঙচুর করে।

আজ (২০ সেপ্টেম্বর) সকালে পিসিজেএসএস সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ কর্তৃক রাঙ্গামাটি জেলা সদরে ‘সংঘাত ও বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন’ এর ব্যানারে স্থানীয় জনসাধারণ রাঙ্গামাটি জিমনেশিয়াম এলাকায় সমবেত হয়। এ সময় ৮০০-১০০০ জন উত্তেজিত জনসাধারণ একটি মিছিল বের করে বনরুপা এলাকার দিকে অগ্রসর হয় এবং বনরুপা বাজার মসজিদ, অগ্রণী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, সিএনজি- অটোরিক্সা, মোটরসাইকেল এবং বেশকিছু দোকানে ভাঙচুর ও অগ্নি সংযোগ করে। এতে করে উভয় পক্ষের বেশকিছু লোকজন আহত হয়।

উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে রাঙামাটি জেলা সদরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, উপরোক্ত ঘটনাসমূহের পরিপ্রেক্ষিতে চলমান উত্তেজনা তিন পার্বত্য জেলায় ভয়াবহ দাঙ্গায় রূপ নিতে পারে।

অনতিবিলম্বে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গকে চলমান উত্তেজনা প্রশমনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য অনুরোধ জানানো যাচ্ছে। যথাযথ তদন্ত কার্যক্রম সম্পাদনের মাধ্যমে প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের সনাক্তপূর্বক প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিন পার্বত্য জেলায় শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে সর্বসাধারণকে বিশেষভাবে অনুরোধ জানানো যাচ্ছে।-আইএসপিআর

খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে ১৪৪ ধারা জারি

পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে ১৪৪ ধারা জারি জারি করা হয়েছে। পাহাড়ি ও বাঙালি সংঘর্ষের পর ১৪৪ জারি করল স্থানীয় প্রশাসন।

শুক্রবার (২০ সেপ্টম্বর) দুপুরে বিষয়টি নিশ্চিত করেন খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. সহিদুজ্জামান।

তিনি জানান, খাগড়াছড়ি সদর ও পৌরসভা এলাকায় শুক্রবার দুপুর ২টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত এ আদেশ জারি থাকবে। এছাড়া, সব পক্ষকে শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থানের অনুরোধ জানান তিনি।

খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় পাহাড়ি ও বাঙালির সংঘর্ষের জের ধরে বৃহস্পতিবার রাতভর খাগড়াছড়ি জেলা সদরে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে সদরসহ পুরো জেলায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। রাতের গোলাগুলি ও বিকালের সংঘর্ষের ঘটনায় তিনজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ১৫ জন।

নিহতরা হলেন- জুনান চাকমা (২০), ধনঞ্জয় চাকমা (৫০) ও রুবেল চাকমা (৩০)। এদিকে নাশকতা রোধে খাগড়াছড়ি পৌর শহর ও জেলা সদরে ১৪৪ ধারা জারি করেছে জেলা প্রশাসন।

জেলা প্রশাসক মো.সহিদুজ্জামান বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, যে কোনো ধরনের সহিংসতা রোধে এ ব্যবস্থা নিয়েছে প্রশাসন।

বৃহস্পতিবার রাতে (আনুমানিক রাত সাড়ে ১০টা) জেলা শহরের নারানখখাইয়া, স্বনির্ভর এলাকায় ব্যাপক গুলির শব্দ শোনা যায়। পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। গভীর রাত পর্যন্ত গুলির শব্দ পাওয়া যায়।

শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) খাগড়াছড়ির ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাঙামাটিতেও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এসময় ঘটনায় জড়িত উভয় পক্ষের অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছেন। নিহত হয়েছেন একজন। তবে নিহতের নাম পরিচয় জানা যায়নি। এসময় বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর ও দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ করা হয়।

এ পরিস্থিতিতে শুক্রবার দুপুরে জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোশারফ হোসেন খান স্বাক্ষরিত গণবিজ্ঞপ্তিতে ১৪৪ জারি করা হয়।

গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রাঙ্গামাটি জেলার পৌরসভা এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে এবং জনগণের জানমাল ক্ষতিসাধনের আশঙ্কা রয়েছে। তাই আজ শুক্রবার দুপুর ১টা হতে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার পৌরসভা এলাকায় ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ মোতাবেক ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে।

এ আদেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে গণবিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, শুক্রবার সকালে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা ঘটনাকে কেন্দ্র করে আদিবাসী ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে রাঙামাটি শহরের বনরূপা এলাকায় আসে।

এ সময় তারা বেশ কয়েকটি গাড়ি ও দোকানে হামলা চালায়। খবর পেয়ে বাঙালিরা প্রতিরোধের চেষ্টা করলে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।

সংঘর্ষের ঘটনায় বেশ কিছু দোকানে অগ্নিসংযোগও করা হয়। পরে সেনবাহিনীর সদস্যরা এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। তবে শহরে এখনো পরিস্থিতি থমথমে রয়েছে। শহরে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর টহল জোরদার করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার বিকালে খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় ‘পাহাড়ি ও বাঙালিদের’ মধ্যে সংঘর্ষ থেকে স্থানীয় বাজারে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

জেলা পুলিশ সুপার আরিফিন জুয়েল বলেন, সেখানে পাহাড়ি-বাঙালি উত্তেজনা চলছিল। সেখান থেকেই বৃহস্পতিবার সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। এ সময় দুপক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে এবং দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ করা হয়।

স্থানীয়রা বলেন, বুধবার সকালে চুরির অভিযোগে ‘গণপিটুনিতে’ মামুন নামে এক যুবক হত্যার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার বিকালে বিক্ষোভ মিছিল বের করে দীঘিনালা ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থীরা।

বিক্ষোভ মিছিলের এক পর্যায়ে সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে। পরে লারমা স্কয়ারের দোকানপাটে আগুন দেয় একপক্ষ। এতে ৬০ থেকে ৭০টি দোকান পুড়ে গেছে বলে দাবি ক্ষতিগ্রস্তদের।

তিন পার্বত্য জেলার সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার

তিন পার্বত্য জেলার সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আজ বিকালে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক বার্তায় এ আহ্বান জানানো হয়।

বার্তায় বলা হয়েছে, ১৮ সেপ্টেম্বর এক ব্যক্তিকে গণপিটুনি ও পরবর্তী সময়ে তাঁর মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে চলমান হামলা, আক্রমণ ও প্রাণহানির ঘটনায় সরকার গভীরভাবে দুঃখিত ও ব্যথিত। সরকারের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সব বাহিনীকে সর্বোচ্চ সংযম দেখাতে এবং পার্বত্য তিন জেলায় বসবাসকারী জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেখানে শান্তি, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি নিশ্চিতকরণে সরকার বদ্ধপরিকর।

আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়া এবং ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত না হওয়ার জন্য সবাইকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। বার্তায় বলা হয়েছে, আইন নিজ হাতে তুলে নেওয়া এবং যেকোনো সম্পত্তি ধ্বংস করা দণ্ডনীয় ও গর্হিত অপরাধ। সহিংসতার সঙ্গে সম্পর্কিত সব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত আর দায়ী ব্যক্তিদের বিচার নিশ্চিত করা হবে। এ লক্ষ্যে একটি শক্তিশালী তদন্ত কমিটি শিগগিরই গঠন করা হবে। আহত ব্যক্তিদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আগামীকাল শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার নেতৃত্বে সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি পরিদর্শন করবে বলে বার্তায় জানানো হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, এই প্রতিনিধিদলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক উপদেষ্টা, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা এবং প্রতিরক্ষা ও জাতীয় সংহতি উন্নয়নবিষয়ক প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী থাকবেন।

About admin

Check Also

দুই মাসেই দেউলিয়া হওয়ার পথে বাংলাদেশ : বাহাউদ্দিন নাছিম

বাংলাদেশ দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *