বাংলাদেশে সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানের পর প্রশাসন এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। এ পরিবর্তনের অংশ হিসেবে আগামী বছরের প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠ্যপুস্তকে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে।
নতুন পাঠ্যপুস্তকে যুক্ত হবে জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থানের গ্রাফিতি, যা বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতিফলন। এদিকে, বইয়ের প্রচ্ছদ থেকে বাদ পড়ছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি সংবলিত উক্তি।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান জানিয়েছেন, ইতিহাসে যার যেভাবে ভূমিকা ছিল, তা সেভাবেই সন্নিবেশিত করা হবে। মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার ইতিহাসে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, তাদের অবদানকে নতুনভাবে উপস্থাপন করা হবে।
এ পরিবর্তন শিক্ষার্থীদের কাছে দেশের ইতিহাসের একটি সাম্য ও সঠিক চিত্র তুলে ধরবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তিনি আরও বলেন, আগামী বছরের পাঠ্যপুস্তক ২০২৪ সালের বিদ্যমান পাঠ্যক্রমে নয় বরং ২০১২ সালের পাঠ্যক্রমে হচ্ছে।
হাসান বলেন, ‘যে কারিকুলামটা বিদ্যমান ছিল ২০২৪ এর জন্য সেটাতে না গিয়ে ২০২৫ সালের জন্য ২০১২ সালের কারিকুলাম অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তক প্রণীত হচ্ছে, যেটা ২০২২ সালে সর্বশেষ গিয়েছিল।’
বিভিন্ন শ্রেণির বেশ কিছু পাঠ্যপুস্তকে দেশের গণঅভ্যুত্থানের চেতনার প্রতিফলন থাকবে। আরও যে কয়েকটি পরিবর্তন আনা হচ্ছে তা নিয়েই বিবিসি বাংলার এ লেখা।
যুক্ত হচ্ছে গণঅভ্যুত্থানের গ্রাফিতি
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে গড়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মূল দাবি একসময় সরকার পতনের এক দফা দাবিতে রূপ নেয়।
এ আন্দোলনে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে দেয়াল চিত্রকে বেছে নেয়।
শেখ হাসিনার সরকার পতনের পরও পুরো ঢাকা শহরের বিভিন্ন দেয়ালে দেয়ালে শিক্ষার্থীরা গ্রাফিতি আঁকে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বহু ভবনের দেয়াল, সীমানা প্রাচীর, সড়ক-দ্বীপ, মেট্রোরেলের স্তম্ভ, উড়াল সড়কের স্তম্ভ কোনো কিছুতেই নিজেদের অর্থে গ্রাফিতি আঁকতে বাদ রাখেনি শিক্ষার্থীরা।
এসব গ্রাফিতিতে ওই সময়টুকুকে ধারণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। অভ্যুত্থানে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের প্রতিকৃতি ও তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে গ্রাফিতিতে।
পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, রাষ্ট্র-সমাজের সংস্কার, ঘুস-দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, স্বৈরতন্ত্রের অবসান, বাক-স্বাধীনতা, অধিকার নিশ্চিত করা থেকে শুরু করে সব ধরনের অন্যায় – অবিচারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ আর প্রতিরোধের উক্তিও ফুটে উঠেছে এসব গ্রাফিতিতে।
এনসিটিবির কর্মকর্তারা জানান, জুলাইয়ের গ্রাফিতি যে সবগুলো বইয়ে যাবে তা নয়, কিছু কিছু বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
একইসঙ্গে যেহেতু ২০২৪ এর জুলাইয়ের অভ্যুত্থানের বিষয়টি একেবারেই সাম্প্রতিক এবং তা নিয়ে লেখা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এ বছর সময়ও একেবারেই কম, ফলে লেখা হিসেবে না রেখে কিছু পাঠ্যবইয়ে অভ্যুত্থানের গ্রাফিতি বা দেয়ালে আঁকা ছবি রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনসিটিবি।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান বলেন, ‘২৪ এর জুলাইয়ের ঘটনাবলী, এ জাতীয় যে সব লেখা রয়েছে তা আসলে কতটা মানসম্পন্ন আর লেখাগুলো তৈরি করাও বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তারপরও কিছু বিষয় যেতে পারে কিন্তু সেটা মন্ত্রণালয়ের অনুমতি প্রয়োজন। এখনও অনুমোদন আমরা পাইনি।’
তিনি বলেন, ‘তবে কিছু কিছু বইয়ের ব্যাক কাভারে কিছু গ্রাফিতি যাচ্ছে, বাচ্চারা দেয়ালে যে চিত্রাঙ্কন এঁকেছে বা মনীষীদের বাণী ওই জাতীয় বিষয় যাচ্ছে। ‘
বাংলা, ইতিহাস, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ের মতো কিছু বইয়ের প্রচ্ছদে বা বইয়ের কোনো কোনো অংশে এসব গ্রাফিতি বা দেয়ালে আঁকা ছবি যুক্ত করা হবে।
‘শেখ হাসিনার উক্তি বাদ দেওয়া হবে’
এখন বেশ কয়েকটি শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের পেছনের প্রচ্ছদে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যেসব ছবি ও উদ্ধৃতি রয়েছে সেগুলো বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনসিটিবি।
বইয়ের শেষ পৃষ্ঠায় থাকা শেখ হাসিনার এসব উক্তিকে অপ্রাসঙ্গিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সেগুলো থাকবে না। সেগুলো অপ্রাসঙ্গিক।’
শিক্ষার্থীদের মনে যাতে রাজনৈতিক কোনো ধারণার উদ্রেক না হয় সে কারণে এসব বাদ দেয়া হচ্ছে বলে ব্যাখ্যা করেন তিনি।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, ‘ওগুলো আসলে পাঠ্যবইতে যাওয়ার মতো নয় বা প্রয়োজন নেই। পাঠ্যবইয়ের কভার পৃষ্ঠা থেকেই শুরু হয় শিক্ষার্থীর শিক্ষামূলক কার্যক্রম। এগুলো দেখে তাদের মধ্যে অন্যরকম ধারণা না তৈরি হয় যে এটা একটা রাজনৈতিক প্রচারণার অংশ। এটা যেন না হয়।’
বইয়ের পেছনের প্রচ্ছদে শেখ হাসিনার উদ্ধৃতির পরিবর্তে চিরন্তন কিছু বাণী যুক্ত করা হবে বলে জানান তিনি।
ইতিহাস বিষয়ক যেসব পরিবর্তন হচ্ছে
বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণির বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকাকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন ইতিহাস নির্ভর বিষয়েও কিছু কাটছাঁট করা হচ্ছে। একইসাথে যুক্ত করা হচ্ছে জিয়াউর রহমানসহ অন্যদের ভূমিকাও।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান বিষয়টি স্বীকার করে বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘ইতিহাসের বিষয় আছে, যেগুলোতে যার যার ভূমিকা সেটা সঠিকভাবে ছিল না। এরকম অভিযোগ আছে। আমরাও পেয়েছি। সেগুলো দেখা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, যার যতটুকু ভূমিকা সেভাবে দেওয়া হবে। যেমন: মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ইতিহাসের অন্যান্য যারা পিলার তাদের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
‘মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন’- এমন বিষয়ও যুক্ত হচ্ছে আগামী বছরের পাঠ্যইয়ে।
হাসান বলেন, ‘স্বাধীনতার ঘোষণায় আমাদের তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান একাধিক ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেগুলো সেভাবেই আসবে আশা করছি।’
একইসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অন্যান্যদের যে ভূমিকা তাও অন্তর্ভুক্ত করা হবে বলে জানান তিনি।
‘এছাড়া মাওলানা ভাসানী, তাজউদ্দীন আহমেদ, জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী যার যা ভূমিকা এগুলো ইতিহাসের অংশ হিসেবে যুক্ত করা হবে।’
গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের কথা অন্তর্ভুক্ত হবে?
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে গত ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ নিহত হন। পুলিশের গুলির বিপরীতে বুক পেতে দাঁড়িয়ে যান তিনি।
বিভিন্ন ভিডিওতে পুলিশ গুলি করার পর সাঈদকে ঢলে পড়তে দেখা যায়। পরে মারা যান তিনি। যদিও পুলিশ যে মামলা করে তাতে ভিন্ন বক্তব্য থাকায় তা নিয়ে চলে তুমুল সমালোচনা। সাঈদের এ মৃত্যু সে সময় তোলপাড় তোলে দেশে।
এ আন্দোলনে ঢাকায় ১৮ জুলাই নিহত হয়েছেন এমন একজন মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস এর ছাত্র মুগ্ধ উত্তরায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন।
আন্দোলনকারীদের পানি সরবরাহ করছিলেন মুগ্ধ। উত্তরাতেই বাসা তার।
আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে তার বলা ‘পানি লাগবে, পানি, পানি লাগবে, পানি’ এ উক্তি পরবর্তীতে আন্দোলনের প্রধান স্লোগানে পরিণত হয়।
গণঅভ্যুত্থানে নিহত এ দু’জনের কথা পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে ইতোমধ্যেই আলোচনা হয়েছে বলে জানান এনসিটিবির চেয়ারম্যান। তবে এখনো মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে অনুমোদন পাওয়া যায়নি বলে জানান হাসান।
তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এটা এখনও সিদ্ধান্ত আসে নাই। আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে সিদ্ধান্ত আসলে আমরা বলতে পারবো। এখনো সিদ্ধান্ত পাইনি তো, এজন্য যুক্ত করার কথা বলা যাবে না।’
মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত দেরিতে আসলেও আগামী বছরের বইতে শেষ মুহূর্তেও এ বিষয় বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব বলে জানান তিনি।
হাসান বলেন, ‘ছাপাখানায় কিছু বই চলে গেছে, কিছু বই এখনও যাওয়ার অপেক্ষায় আছে। জানুয়ারিতে বই দেয়ার জন্য আমাদের প্রিন্টারদের সঙ্গে আমাদের কথা হচ্ছে। বই দেওয়ার জন্য তাদের প্রস্তুতিও আছে। এখন তারা যদি সব সহযোগিতা করে তাহলে তা সম্ভব, কঠিন হলেও অসম্ভব নয়।’
মূল্যবোধের বিষয় যুক্ত হবে
আগামী বছরের পাঠ্যবইয়ে যাতে কোনো গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বা কারো প্রতি আঘাত না করা হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে সব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে বলে জানান এনসিটিবির চেয়ারম্যান এ কে এম রিয়াজুল হাসান।
হাসান বলেন, ‘আমাদের দেশের মূল্যবোধ, ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক কোনো কিছু পাঠ্যবইয়ে থাকবে না।’
সতর্কতার জন্য এটা করা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠী বা সামাজিক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী তারা যেন আহত না হয় বা তাদের বিষয়ে যাতে বিরূপ কোনো মন্তব্য না থাকে সেটা দেখা হয়েছে। কাউকে আঘাত যেন করা না হয় সে বিষয়টি দেখা হচ্ছে।’