কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সাভারের পাকিজা মডেল মসজিদের কাছে গত ১৮ জুলাই ঘটনাটি ঘটে। মহাসড়কের ওপর পুলিশের এপিসি গাড়ি থেকে ফেলে দেওয়া হচ্ছে ন্যুজ এক তরুণকে। গাড়ি থেকে সড়কে পড়তেই দুই হাত দুই দিকে আর পা দুটি ভাজ হয়ে যায়। একটি পা আটকে যায় এপিসির চাকার সঙ্গে। তখনও জীবিত ওই তরুণ। শ্বাস নিতে দেখা যায় তাকে। গাড়িটি থেকে পুলিশের এক সদস্য নেমে হেঁচকা টানে ওই তরুণকে সড়কের মাঝের দিকে ফেলে দেন। এরপর সড়ক বিভাজক পার করে তাকে ফেলা হয় সড়কের সার্ভিস লেনে। যেন মানুষ নয়, কোনো জড় বস্তু টানা হচ্ছে!
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সাভারের পাকিজা মডেল মসজিদের কাছে গত ১৮ জুলাই ঘটনাটি ঘটে। পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। হতভাগ্য ওই তরুণের নাম শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন।
শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন ঢাকার মিরপুরের মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। এমআইএসটির ওসমানী হলের বাসিন্দা ছিলেন তিনি। পরিবার থাকত সাভারের ব্যাংক টাউন আবাসিক এলাকায়।
ইয়ামিনের বাবা মো. মহিউদ্দিন ঢাকা ট্রিবিউনকে জানান, ১৭ জুলাই সকালে এমআইএসটির হল থেকে বাসায় আসেন ইয়ামিন। ১৮ জুলাই বাবার সঙ্গে জোহরের নামাজ পড়তে যান ইয়ামিন। এরপর তাদের আর দেখা হয়নি। তাকে মুঠোফোনে কল দেওয়া হলেও ধরেনি। বেলা ৩টার দিকে একজন ফোন করে ইয়ামিনের মাকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে যেতে বলেন। সেখানে গিয়েই ইয়ামিনের মরদেহ দেখতে পায় পরিবার।
কি ঘটেছিল সেদিন
১৮ জুলাই সকাল থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত পুরো এলাকা ছিল শান্ত-স্বাভাবিক। বেলা ১১টার দিকে সাভারের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাকিজা মোড় এলাকায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। সেখানে বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও বিজিবি সদস্যও অবস্থান নেয়। এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীরা পুলিশকে উদ্দেশ্য করে স্লোগান দিতে শুরু করে। একপর্যায়ে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ারশেল নিক্ষেপ শুরু করে। এতে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘাত বাধে। ওই সময় পুলিশের একাধিক যানবাহন ভাংচুর করা হয়।
পুলিশের টিয়ারশেল ও রাবার বুলেটের মুখে সেখানে আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। একই সময়ে ওই এলাকায় মাথায় হেলমেট পরে অস্ত্রসহ অবস্থান নেয় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের কয়েকশত নেতাকর্মী। তাদের হাতে লোহার রড, বাঁশের লাঠি, রাম দা, এমনকি বেশ কয়েকজনের হাতে পিস্তল ও শটগান ছিল।
উল্লেখযোগ্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, সাভার উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আতিকুর রহমান আতিক, উপজেলা চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম রাজিবের সম্বন্ধী রুবেল। তাদের অনেকের হাতে ছিল আগ্নেয়াস্ত্র।
পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হামলার মুখে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় আন্দোলনকারীরা। এ সময় এলাকাটি নিয়ন্ত্রণে নেয় পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। আর ছত্রভঙ্গ আন্দোলনকারীরা জড়ো হয় সাভার বাস স্ট্যান্ড ও এর আশেপাশের বিভিন্ন গলি ও পয়েন্টে। এরপর বেলা ১২টার দিকে আবারও আন্দোলনকারীরা সাভার মডেল মসজিদের সামনের মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। সেখানে একদিকে পুলিশ-বিজিবি ও সশস্ত্র আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা অন্যদিকে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা।
সেখানেও পুলিশের টিয়ার শেল ও গুলিতে আন্দোলনকারীরা পিছু হটে অবস্থান নেয় সাভার ব্যাংক কলোনি মহল্লার বিভিন্ন গলিতে। সেখানে ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা চলতে থাকে। এরপর আন্দোলনকারীরা সাভার বাসস্ট্যান্ড এলাকার পুরাতন ওভার ব্রিজ, সিটি সেন্টার, রাজ্জাক প্লাজা ও মহাসড়কের বিপরীত দিকের সার্ভিস লেন ও অলিগলিতে অবস্থান নেয়। সেখানে তারা লোহার ব্যারিকেড ও আগুন জ্বালিয়ে মহাসড়ক অবরোধ করে। একই সময় সাভার বাস স্ট্যান্ড এলাকার একাধিক পুলিশ বক্সে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে তারা। পুরো এলাকায় সৃষ্টি হয় যুদ্ধক্ষেত্র।
ওই সময় আন্দোলনকারীদের দিক থেকে ইট-পাটকেল ছোঁড়া হচ্ছিল। আর পুলিশ গুলি ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করছিল। এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীরা মানিকগঞ্জগামী সার্ভিস লেনের রাজ্জাক প্লাজা ও তার আশেপাশের পয়েন্টে ও মহাসড়কের বিপরীত দিকের সার্ভিস লেন ও অলিগলিতে অবস্থান নিয়ে প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছিল।
মহাসড়কে সেই নেভি ব্লু রঙের এপিসি
দুপুর ২টার দিকে মহাসড়কে দেখা মেলে নেভি ব্লু রঙের পুলিশের একটি এপিসি। মহাসড়কের মূল লেনে অবস্থান নিয়ে সেটি থেকে আন্দোলনকারীদের দিকে রাবার বুলেট, ছররা গুলি ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করতে শুরু করে পুলিশ সদস্যরা। বেলা আড়াইটার দিকে এপিসিটি সাভার বাসস্ট্যান্ডের পুরাতন ওভার ব্রিজের কাছাকাছি এলে শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন সড়ক বিভাজক টপকে ওই এপিসির ওপরে উঠে যায়। তখনই বুকের বাম পাশে গুলি লাগলে পড়ে যায় ইয়ামিন। এ সময় এপিসির ওপরের ঢাকনা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
সূত্র বলছে, এপিসির ভেতরে মাঠ পর্যায়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তাসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য ছিলেন।
যে দৃশ্য নির্মম-নিষ্ঠুর-অমানবিকতার
ইয়ামিন এপিসির ওপরে লুটিয়ে পড়ার পর সেটি অবস্থান বদলে সাভারের রানা প্লাজা ও ভ্যাট অফিসের মাঝামাঝি এলাকায় আসে। তখন এপিসির ভেতর থেকে পুলিশের এক সদস্য বাম দিকের দরজা খুলে দেন। তখন আরেকজন পুলিশ সদস্য এপিসির ওপরের ঢাকনা খুলে ওপরে উঠে ইয়ামিনকে টেনে সড়কে ফেলে দেন। ওই সময়ও ইয়ামিন জীবিত ছিল। তাকে শ্বাস নিতে দেখা যায়। পরনে ছিল একটি নেভি ব্লু কালারের ট্রাউজার এবং গায়ে অনেকটা খয়েরি রঙের জামা।
এপিসি থেকে তাকে ফেলে দেওয়া হলে তার দুই হাত দুই দিকে পড়ে, আর একটি পা ভাজ হয়ে পড়ে। আরেক পা এপিসির বাঁ দিকের চাকার সঙ্গে আটকে যায়। তখন এপিসি থেকে পুলিশের এক সদস্য নেমে ইয়ামিনের হাত ধরে টেনে তাকে সরিয়ে নেন মহাসড়কের মাঝের দিকে। এরপর আরও দুইজন পুলিশ সদস্য এপিসি থেকে নেমে তাকে মূল সড়ক থেকে টেনে সড়ক বিভাজকের কাছে নেন। এরপর টেনে তাকে সড়ক বিভাজকের ওপর দিয়ে সার্ভিস লেনে ফেলে দেয়।
ওই সময়ও সড়কের সার্ভিস লেনে থাকা পুলিশ সদস্যরা মুহুমুহু গুলি ছুঁড়ছিলেন। ইয়ামিনকে যখন ফেলা হয় তখনও নিচে থাকা পুলিশ সদস্যরা বলতে থাকেন, “গুলি কর, গুলি কর, পিস্তল দিয়ে গুলি কর।”
লাশ পড়ে থাকে মহাসড়কে
পুলিশ সদস্যরা ইয়ামিনকে সার্ভিস লেনে ফেলে সেখান থেকে সরে যায়। ওই সময় একটি টিয়ার শেল পড়ে তার পাশেই। ওই সময় তাকে ওভাবে ফেলেই সবাই সেখান থেকে সরে যায়। প্রায় ১ ঘণ্টা পর স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ইয়ামিনের বুকের বা পাশ গলায় অসংখ্য ছররা গুলির চিহ্ন দেখা যায় বলে জানান চিকিৎসকরা।
এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. মিজারুল রেহান পাভেল ও ডা. হাসান মাহবুব ইয়ামিনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে ১৮ জুলাই বলেছিলেন, “অসংখ্য রাবার বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে অধিক রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়েছে।”
ইয়ামিনের বাবা মো. মহিউদ্দিন বলেন, “খবর পেয়ে হাসপাতালে যাওয়ার পর এক চিকিৎসক একটি তালা দেওয়া কক্ষের সামনে নিয়ে যান। সেই কক্ষের তালা খোলার পর একটি স্ট্রেচারে ইয়ামিনকে দেখতে পাওয়া যায়। চিকিৎসক জানায় হাসপাতালে আনার আগেই ইয়ামিনের মৃত্যু হয়েছে। এরপর অ্যাম্বুলেন্সে করে দ্রুত মরদেহ বাসায় এনে সাভারের আবাসিক কলোনির কবরস্থানে দাফন করা হয়।”
তিনি বলেন, “একজন জীবন্ত মানুষকে এভাবে কোনো মানুষ নিচে ফেলে দিতে পারে না। আমি কারও কাছে বিচার চাই না। জিডি করিনি। ছেলের লাশের পোস্টমর্টেম করাইনি। শুধু আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছি। সবাই দোয়া করবেন, আমরা যেন ধৈর্য ধরতে পারি।”
কোটা সংস্কার আন্দোলনে ঢাকার সাভারে নিহত প্রথম শিক্ষার্থী ছিলেন ইয়ামিন। মৃত্যুর ১২ ঘণ্টা আগে ফেসবুকে দেওয়া পোস্টে ইয়ামিন লিখেছিলেন, “শুধু কোটা নয়; গোটা দেশটাই সংস্কার প্রয়োজন।”