বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার শোহান শাহ (২৯)। দীর্ঘ ৩৯ দিন বুকে বুলেট নিয়ে অবশেষে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার (২৯ আগস্ট) বিকেলে শ্রীপুর সদরে আলতাফ হোসেন মহিলা কলেজ রোডে শোহানদের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার বাড়িতে শোকের মাতম চলছে। বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন শোহানের মা। অপলক তাকিয়ে আছেন তার বাবা। তার স্ত্রীর বিলাপ কিছুতেই থামছে না।
সোহানের স্ত্রী শম্পা বেগমের বিলাপ কিছুতেই থামছে না। শম্পা বেগম বলেন, ‘তাদের বিয়ে হয়েছিল ২০১৭ সালের ১৯ নভেম্বর। এরপর মধ্যে তিন বছর দুজন একসঙ্গে ঢাকায় সংসার পেতেছিলেন। বাকি সময় স্ত্রীকে গ্রামে পরিবারের সঙ্গে রেখে ঢাকায় চাকরি করেছেন শোহান। আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবার। অর্থসংকটের কারণে ও একা ঢাকায় থাকত। অর্থের কারণে দুজন একসঙ্গেও থাকতে পারিনি। গত এক বছর বাড়িতে একটা নতুন ঘর দিচ্ছিল। সে আমাকে বলেছিল, শম্পা, আমি আর তুমি এই ঘরে থাকব।’
মঙ্গলবার ঢাকায় সিএমএইচে শোহান শম্পাকে বলেছিলেন, ‘তুমি কেঁদো না। আমার কিছুই হবে না। তবে শোহান আর ফেরেননি। অস্ত্রোপচার করে শরীর থেকে বুলেট বের করা গেলেও রক্ত বন্ধ করা যায়নি। ১৮ ব্যাগ রক্ত দিয়েও বাঁচানো যায়নি শোহানকে। সংসারে অভাব থাকলেও ভালোবাসার কমতি ছিল না। স্বামী ছাড়া কেউ ছিল না আমার। সে সব সময় সব ধরনের পরিস্থিতিতে আমার পাশে থেকেছে। সে বলত, চিন্তা করো না, আমি তোমার পাশে আছি। আল্লাহ আমাকে একটা সন্তানও দেননি। আমি এখন কীভাবে বাঁচব?’
সোহানের বাবা শাহ সেকেন্দার বলেন, ‘আমার ছেলে ছোটবেলা থেকেই স্মার্ট, কর্মঠ আর দায়িত্বশীল। ছোটবেলা থেকেই ইনকাম করে। বিশেষ করে বিয়ের পর একদিনও বসে থাকেনি। চাকরি না থাকলে বাড়িতে এসে রাজমিস্ত্রির কাজও করেছে। আমার পকেটখরচও সে দিত। যেদিন মারা গেল সেদিন সকালেও বিকাশে আমাকে এক হাজার টাকা পাঠিয়ে বলল, এই টাকাটা তুলে চলে আসেন।’
ছেলে হারানোর শোকে বিলাপ করতে করতে শোহানের মা সুফিয়া বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে আমার মনের কথা বুঝত। কোনো কথা লুকালে ও বুঝে ফেলত। টাকা পাঠিয়ে বলত, “মা তুমি আঁচলে গুঁজে রেখো না, যা লাগে কিনে খাও আমি আছি তো। আমার ইনকাম না খেয়ে তোমাদের মরতে দেব না।”’ সুফিয়া বেগম বলেন, ‘এখন এই কথা আমাকে কে বলবে? সবাই আছে শুধু আমার ছেলে নেই।’
জানা গেছে, মাগুরার শ্রীপুর ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে প্রায় ১০ বছর আগে সংসারের হাল ধরতে চাকরিতে যান শোহান। সবশেষ ঢাকার রামপুরা এলাকায় একটি পোশাক কারখানায় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করছিলেন তিনি। তার বাবা শাহ সেকেন্দার এক দশকের বেশি সময় আগে নিজের ব্যবসা গুটিয়ে বেকার হয়ে পড়েন। তার একমাত্র ছোট ভাই অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। মা-বাবা, স্ত্রী ও স্কুলছাত্র ছোট ভাইয়ের সব খরচের জোগান আসত একজনের বেতন থেকেই।
অর্থ সাশ্রয়ের জন্য স্ত্রীকে বাড়িতে মা-বাবার কাছে রেখে ঢাকায় মেসে থেকে চাকরি করছিলেন তিনি। গ্রামের বাড়িতে নতুন ঘর নির্মাণ করা হচ্ছিল। যেখানে স্ত্রীর সঙ্গে সুখের সংসার পাততে চেয়েছিলেন শোহান। তবে তাদের সেই স্বপ্ন আর পূর্ণ হল না। গত ১৯ জুলাই ঢাকার রামপুরা এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন শোহান। এর ৩৯ দিন পর ২৭ আগস্ট ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। গত বুধবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শোহানের মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে ওই দিন বিকেলে শ্রীপুর গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ জুলাই শ্রীপুর থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইন ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে একটি মামলা করেন থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আবদুল খালেক। সেখানে আসামি হিসেবে ৯৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। অজ্ঞাতনামা আসামি দেখানো হয় ১৫০ থেকে ২০০ জনকে। মামলার এজাহারে ১৮ নম্বর আসামি হিসেবে নাম রয়েছে শাহ সেকেন্দারের (এজাহারে সেকেন্দার শাহ লেখা হয়েছে) ছেলে শোহানের। মামলার অভিযোগে বলা হয়, ওই দিন (২৪ জুলাই) সকাল ৬টার দিকে শ্রীপুরের আলতাফ হোসেন মহিলা কলেজ মাঠে জড়ো হয়ে ককটেল বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির করছিলেন আসামিরা।
এ বিষয়ে শাহ সেকেন্দার বলেন, ‘আমার ধারণা, ওর গুলি লেগেছে, এটা জেনেই এলাকার লোকজন ও পুলিশ ষড়যন্ত্র করে মামলায় তাকে আসামি করেছে। আমার ছেলেকে গুলি করা থেকে শুরু করে চিকিৎসায় বাধা দেওয়া, মিথ্যা মামলা দেওয়া সব অপরাধের ন্যায়বিচার চাই আমি।’
Sotto TV We Publish technology, various types of tips, career tips, banking information, methods of earning online